ফেনী হবে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন জেলা

জাহাঙ্গীর ফিরোজ

১৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০৮:০৪ পূর্বাহ্ন

ফেনী হবে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন জেলা

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও উষ্ণ আতিথেয়তার জেলা ফেনীতে স্বাগতম।
ফেনী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই ফেনী একটি প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূখণ্ড হিসেবে পরিচিত। ফেনী জেলার উত্তরে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য,  দক্ষিণে নোয়াখালী জেলা, চট্টগ্রাম জেলা ও বঙ্গোপসাগরের সাগরের মোহনা, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই এবং পশ্চিমে নোয়াখালী জেলার সেনবাগ ও কোম্পানিগঞ্জ।
১৯৮৪ সালে ফেনী জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর আয়তন ৯২৮.৩৪ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ১৬ লক্ষ।

ফেনীর নামকরণ সম্পর্কে স্থানীয়ভাবে নানা ধরনের জনশ্রুতি রয়েছে। এতদসত্বেও, ধারণা করা হয় যে, ফেনী নদীর  নামানুসারে  এই জনপদের নাম ফেনী হয়েছে।
পর্যটন একটি বহুমাত্রিক শিল্প। বিশ্বের সবচেয়ে  দ্রুততম সম্প্রসারণশীল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। স্বরনাতীত কাল থেকে মানুষ দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ১৯৩৯ সালে জাতিসংঘ সর্বপ্রথম পর্যটন শব্দটি ব্যবহার করে। ১৯৭৫ সালে বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (UNWTO)সৃষ্টি হয়। বিশ্ব জিডিপি'র ৯% পর্যটন শিল্প থেকে আসে। বিশ্বের কর্মসংস্থানের মধ্যে প্রতি ১১ জনে ১জন পর্যটন শিল্পে কর্মরত আছে। জ্বালানি ও রাসায়নিক দ্রব্যের পরে পর্যটন হচ্ছে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত।  প্রতিবছর ১.৪ বিলিয়ন আন্তর্জাতিক টুরিস্ট পৃথিবী ভ্রমণ করে এবং এ থেকে আয় হয় ১.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। পর্যটক আগমন ও পর্যটন শিল্প হতে আয়ের দিক থেকে এখনো ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন ও চায়না শীর্ষে রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ইন্ডিয়া, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইন পর্যটন শিল্পে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশও হতে পারে এক অনন্য পর্যটন শিল্পের দেশ। বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশের এক অবিশ্বাস্য  উন্নয়ন ঘটেছে । বাংলাদেশ বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়া বাংলাদেশে এখন  পর্যটন শিল্পের কর্মকাণ্ডের জন্য সুপ্রশস্ত  দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রামীণ উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং তদানুযায়ী উন্নয়নের ছোঁয়া বাংলাদেশের প্রত্যন্তর গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে গেছে। সম্প্রদায় ও গ্রামীণ পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করে গ্রামবাসীর কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
সুজলা -সুফলা, শস্য-শ্যামলা অপরূপ  প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি প্রিয় ফেনী জেলা । গাছপালা,  বনজঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, জলাভূমি ও  নদ-নদী  এই জনপদের  প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ; যা পর্যটকদেরকে অতি  সহজেই আকর্ষণ করতে পারে। এখানকার মানুষের স্বকীয়তা,  জীবন, জীবিকা, শিক্ষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  প্রাকৃতিক দুর্যোগ- ঘূর্ণিঝড়, বন্যা  ইত্যাদি মোকাবেলা করতে হয় বলে এখানকার মানুষ অত্যন্ত সাহসী ও পরিশ্রমী।  বর্তমানে ফেনীতে ছয়টি উপজেলা :ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পশুরাম, দাগনভূঁইয়া ও সোনাগাজী। পৌরসভা:  ৫টি, ইউনিয়ন: ৪৩টি,  গ্রাম: ৫৬৪। ফেনী একটি প্রাচীন জনপদ। এই জনপদে প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নিদর্শন রয়েছে। ফেনীর মধ্যযুগের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে প্রখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনী উল্লেখযোগ্য।


বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল পুরোদমে চালু হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমনে ফেনী হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত ও কর্মচঞ্চল। ফেনী জেলার পর্যটন উপাদান, সম্পদ ও আকর্ষণগুলোকে উন্নয়ন ও নতুন মোড়কে আবৃত করে পর্যটকদের কাছে লোভনীয় ও উপভোগ্য পণ্য হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে। বিপণন কৌশল প্রয়োগ করে ব্র্যান্ডিং ও পজিশনিং করা হলে ফেনী জেলা হয়ে উঠবে পর্যটনের অন্যতম চারণভূমি। ফেনীতে দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম নিম্নরূপ :

রাজাঝির দিঘী : ফেনী জেলার জিরো পয়েন্টে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী দিঘী। জনশ্রুতি আছে যে, ত্রিপুরা রাজ বংশের মহারাজার এক প্রভাবশালী রাজা তাঁর কন্যার অন্ধত্ব দূর করার মানসে ৫/৭ শত বছর পূর্বে এই দিঘীটি  খনন করেছিলেন। বর্তমানে দিঘির পাড়ে ফেনী সদর থানা, ফেনী কোট মসজিদ, অফিসার্স ক্লাব, জেলা পরিষদ পরিচালিত শিশুপার্কসহ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন গড়ে উঠেছে। মোট ১০.৩২ একর আয়তন বিশিষ্ট এ দিঘীটি ফেনীর একটি  ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান।

বিজয় সিং দিঘী : ফেনী শহরের প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে ফেনী সার্কিট হাউজের সামনে  এই দিঘীটি  অবস্থিত। বাংলার বিখ্যাত সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেনের অমর কীর্তি এই দিঘীটি।  চারিদিকে বৃক্ষশোভিত উঁচু পাড় এবং মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ ঘেরা এই দিঘী  শত বছরের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করছে। কথিত আছে যে, তিনি তাঁর প্রিয় মাকে খুশি করার জন্য এই দিঘীটি  খনন করেন।  এর আয়তন ৩৭.৫৭ একর।

পাগলা মিয়ার মাজার: পাগলা মিয়ার মাজার ফেনীর তাকিয়া রোডে অবস্থিত।
পাগলা মিয়ার প্রকৃত নাম হযরত শাহ সৈয়দ আমির উদ্দিন ওরফে পাগলা মিয়া। তবে তিনি তাঁর আসল নামের আড়ালে পাগলা মিয়া নামেই অধিক  পরিচিত ছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন পাগল, আধ্যাত্বিক সাধক এবং সকল ধর্ম ও  জাতের ঊর্ধ্বে এক মহামানবতার প্রতীক। এ মহান পাগল সাধকের আদি নিবাস ছিলো বাগদাদ। তাঁর পিতা ছিলেন সৈয়দ বশির উদ্দিন এবং মাতার নাম সৈয়াদা মায়মুনা খাতুন। পাগলা মিয়া ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। এতদাঞ্চলের  মানুষের জীবন ও কর্মের উপর এই সাধকের গভীর আধ্যাত্মিক প্রভাব  রয়েছে।  তিনি ১৮২৩ সালে (বাংলা ১২৩০ সালে) ফেনীর ফাজিলপুরের ছনুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৮৭ সালে (১২ ৯৩ বাংলা সনের ১৩ই শ্রাবণ) রোজ বুধবার মাত্র ৬৩ বছর বয়সেই ফেনীর তাকিয়া বাড়িতে ইন্তেকাল করেন।

মোহাম্মদ আলী মসজিদ : মোহাম্মদ আলী চৌধুরী  মোগল আমলের একজন  জমিদার ছিলেন। তিনি এই মসজিদটি ১৭৬২ সালে নির্মাণ করেন। এই মসজিদটির  তিনটি ফটক ও তিনটি গম্বুজ রয়েছে। এই মসজিদটি ফেনী জেলার শর্শাদী গ্রামে অবস্থিত।  মসজিদটি জাতীয়ভাবে প্রাচীন কীর্তি  হিসাবে সংরক্ষণ করা হয়।

চাঁদ গাজী ভূঁইয়া মসজিদ : ফেনীর পূর্বাঞ্চলের  একজন স্বনামধন্য জমিদার চাঁদগাজী ভূঁঞা। মোগল আমলে তাঁর এ অঞ্চলে আগমন ঘটে। প্রথমে তিনি ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার দক্ষিণ পশ্চিমে ১৬৩৫ সালে আগমন করেন। পরবর্তী সময় নদীর ভাংগনের কারণে তার প্রচুর ধন সম্পদ এবং লোক লস্কর সহ বর্তমান মাটিয়াগোদা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন এবং মোগল সনদ প্রাপ্ত জমিদার রুপে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
তাঁর জমিদারী অঞ্চল ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের পাদদেশে এবং বর্তমান ফেনী জেলার পূর্বাঞ্চল। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর তৎকালীন ত্রিপুরা মহারাজ্য লক্ষণাদিত্য মানিক্য বাহাদুর কর্তৃক তাঁর
জমিদারীর পতন ঘটে।
তিনি একজন ধর্মভীরু জনহিতৈষী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি চাঁদগাজী ভূঁইয়া মসজিদ, চাঁদগাজী ভূঁইয়া নামীয় বহু দীঘি এবং চাঁদগাজী বাজার ও চাঁদগাজী কাছারী বাড়ী প্রতিষ্ঠা করেন‌।

ফেনী কলেজ : বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে ফেনী কলেজ একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯২২ সালে এই কলেজটি  প্রতিষ্ঠিত হয়। ফেনীর দক্ষিণে চট্টগ্রাম কলেজ ও উত্তরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের মধ্যবর্তী স্থানে এই কলেজটির সুখ্যাতি রয়েছে। ফেনী কলেজ স্থাপনের আগে এ অঞ্চলের স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েরা ঢাকা ও কলকাতায় উচ্চশিক্ষা লাভ করতে যেতেন। ফেনী কলেজ স্থাপনের ফলে স্থানীয় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরাও শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। বর্তমানে কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হিসেবে উন্নীত হয়েছে।  কলেজ বিল্ডিং এর স্থাপত্যকর্ম  অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন।

ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় : ফেনী কলেজের পাশেই অবস্থিত ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।  ১৮৮৬ সালে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। মাধ্যমিক শিক্ষা বিস্তারে ফেনী সরকারি  পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় একটি অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মূলত: মেধাবী  ছাত্ররা এই স্কুলে পড়ালেখা করার সুযোগ পায়। এই স্কুলের ছাত্রদের সুনাম রয়েছে। ফেনী কলেজের মত এই স্কুল বিল্ডিং এর স্থাপত্য সৌন্দর্যও অপূর্ব।

মুহুরী প্রজেক্ট : এটি সোনাগাজী উপজেলার মধ্যে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। ফেনী নদীর স্বচ্ছ জলরাশি, মুহুরী ইরিগেশন প্রজেক্ট এর ৪০ গেইট বিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন রেগুলেটর,বায়ু শক্তি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মুহুরী সেতু,  মৎস্য  হ্যাচারি,  বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চলের অংশ বিশেষ ইত্যাদি এখন অপূর্ব পর্যটন আকর্ষণ। এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিনোদন ও পিকনিক স্পট। শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ এবং পর্যটক ছুটে আসেন এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেষ্টিত পর্যটন স্পটে।  প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর মুহুরী রেগুলেটরের চারদিকে কৃত্রিম জলরাশি, বনায়ন, মাছের অভয়ারণ্য ও পাখির  কলকাকলি এক মনমুগ্ধকর পরিবেশ।  মুহুরী জলরাশিতে নৌকা ভ্রমণের সময় খুব কাছ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস এবং পাখি দেখা যায়।

ভাষা শহীদ আব্দুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর: ভাষা শহীদ আব্দুস সালাম ২৭ নভেম্বর ১৯২৫ সালে ফেনী জেলার দাগন ভূঁইয়া উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামে  জন্মগ্রহণ করেন।রাষ্ট্রভাষা  বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনে রাস্তায় সম্মিলিত হয়ে বিক্ষোভ  প্রদর্শন করে। বিক্ষোভ  চলাকালীন পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেড় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯৫২ সালের ৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।  তাঁর পবিত্র স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য  ফেনী জেলার দাগন ভূঁইয়া উপজেলার সালাম নগরে 'ভাষা শহীদ  আব্দুস সালাম গ্রন্থাগার ও জাদুঘর' স্থাপন করা হয়।

প্রতাপপুর জমিদার বাড়ি : ফেনী জেলার অন্তর্গত দাগন ভূঁইয়া  উপজেলার এক ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি।প্রায় ১৩ একর জায়গা জুড়ে এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। বাড়িটিতে ১০টি ভবন ও ১৩টি পুকুর রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি পুকুর পাকা ঘাট বাঁধানো।
প্রায় ১৮৫০ কিংবা ১৮৬০ সালে এই জমিদার বাড়িটি নির্মিত হয়। এই জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজকৃষ্ণ সাহা কিংবা রামনাথ কৃষ্ণ সাহা। স্থানীয়দের কাছে এটি প্রতাপপুর বড় বাড়ি বা রাজবাড়ি হিসেবেও পরিচিত। এই এলাকার আশেপাশে যত জমিদার ছিল সবার শীর্ষে ছিল এই জমিদার। এই জমিদার বংশধররা জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পরও ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এই জমিদার বাড়িটিতে ছিল। জমিদার বাড়ির বংশধরদের কিছু এখনো ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং কিছু ভারতের কলকাতা ও ত্রিপুরা রাজ্যে আছেন। জমিদার বাড়ির সম্পত্তি এখনো জমিদার বাড়ির বংশধরদের মালিকানাধীন। জমিগুলো এলাকার মানুষের কাছে বর্গা দিয়ে রাখা হয়েছে। জমিদার বাড়ির বংশধররা এখানে বছরের মধ্যে দুইবার আসেন এবং বর্গার টাকা নিয়ে যান।

শমসের গাজীর বাঁশের কেল্লা রিসোর্ট:
ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলায় ভারত সীমান্তের কাছে গ্রাম বাংলার লোক সংস্কৃতির বিভিন্ন উপকরণের সমন্বয়ে শমসের গাজীর বাঁশের কেল্লা রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে। নবাব সিরাজদৌল্লার আমলে “ভাঁটির বাঘ” হিসেবে পরিচিত শমসের গাজী একাধারে ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা, ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী এবং ত্রিপুরার রোশনাবাদ পরগণার কৃষক বিদ্রোহের নায়ক। সোনাপুরে শমসের গাজীর স্মৃতিচিহ্নকে কেন্দ্র করে তাঁর উত্তরসূরিরা প্রায় ৫ একর জায়গার উপর শৈল্পিক আঙ্গিকে এই রিসোর্টটি নির্মাণ করেন।
প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ বেষ্টিত বাঁশের কেল্লা রিসোর্টটি থাইল্যান্ড ও জাপানের গেস্ট হাউজের আদলে পর্যটন স্পট হিসাবে নির্মাণ করা হয়েছে। রিসোর্টের ভিতর ও বাইরের অবকাঠামোতে বাঁশের স্থাপত্য স্থান পেয়েছে। তাছাড়া বাঁশের তৈরী বিভিন্ন আসবাপত্র ও শিল্পকর্ম দিয়ে অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা  করা হয়েছে । রিসোর্টে প্রবেশের  সাথে ঐকতান নামের একটি দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য দেখা যাবে । আর রিসোর্টের আঙ্গিনায় রয়েছে সুউচ্চ বাঁশের সারি এবং সাহিত্য আড্ডা বা যেকোন মুক্ত অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য আছে খাগড়াছড়ির ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি বাড়ীর আদলে নির্মিত বাঁশের মাচাং ঘর।
শমসের গাজীর বাঁশের কেল্লা রিসোর্টে রেস্টুরেন্ট, পাঠকক্ষ, অতিথি কক্ষ, টি কর্ণার ছাড়াও আছে লন, ফোয়ারা, দৃষ্টিনন্দন লেক ও সুদৃশ্য ব্রিজ। আর লেকের পানিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য রয়েছে নৌকার ব্যবস্থা। রিসোর্টের পাশে প্রতিষ্ঠাতা তথা শমসের গাজীর দুইটি কাঁচা ঘর অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। অতিথিদের অত্যাবশ্যকীয় কেনাকাটার জন্য খুচরা দোকান ও চা-কফির স্টল আছে। অগ্রিম বুকিং দিয়ে এখানে বিভিন্ন সভা-সেমিনার, বিয়ে, বনভোজন, বার-বি-কিউ ইত্যাদি  আয়োজন করা যায়।

নির্মাণশৈলীর ভিন্নতার কারণে  ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে এই বাঁশের কেল্লা। এখানে  প্রায়শই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আগত পাহাড়ীদের নৃত্য এই রিসোর্টের বিনোদন আয়োজনের এক অন্যতম অনুষঙ্গ।

রাবার গার্ডেন :
ফেনীর পরশুরাম এর জয়ন্তীনগর গ্রামে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে রাবার বাগান। পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী জয়ন্তীনগর গ্রামে ২০১০ সালে হাজী মো. মোস্তফার মালিকানাধীন প্রায় ২৫ একর জায়গায় ৮,০০০ রাবার প্ল্যান্টস রোপন করা হয়। পরিকল্পিতভাবে লাগানো সারি সারি রাবার গাছের এ বাগান দীর্ঘ ৮ বছর পরিচর্যার পর ২০১৮ সালের দিকে প্রথম কষ আরোহণ করা হয়। সারি সারি রাবার গাছের বাগানে ঢুকলে  সবুজের সমারোহে মন ভরে যায়।  দর্শনার্থীরা যতই বাগানের ভিতরে ঢুকবে, ততই তারা বাগানের সৌন্দর্য ও বিশালতা দেখে  মুগ্ধ হবে। বাগানের  চতুর্দিকে ঘুরে দেখতে দেখতে কখন যে সময় পার হয়ে যায়, অনুমান করা যায় না।
বাগানটি  ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। তাই, মালিকপক্ষের অনুমতি ছাড়া বাগানে ঢুকা যায় না।তবে অনুমতিক্রমে সবাই ভিতরে যেতে পারে। সেখানে শর্ত থাকে যে, বাগানের ভিতরে কোন দিয়াশলাই বা আগুন জ্বালানোর উপাদান নিয়ে ঢুকা যাবে না। আর ধুমপান একদম নিষিদ্ধ। কারণ শুকনো পাতা কোনক্রমে আগুনের সংস্পর্শে আসলে, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হবে এবং অগ্নি দাবানলে  বাগান ভস্মিভূত হয়ে যাবে।
বাগানের ওপারেই আছে কাটা তারের বেড়া; যা বাংলাদেশ -ভারত সীমান্ত।  তার সাথেই আছে পরশুরাম রিজার্ভ ফরেস্ট। ফরেস্ট ট্রেকিং এর প্রস্তুতি থাকলে সেখানে ঘুরে আসা যায়।

শ্রী শ্রী মা মাতঙ্গী দেবী মন্দির : এই মন্দিরটি পরশুরাম  উপজেলায় অবস্থিত। মন্দিরটির স্থাপত্য সৌন্দর্য অসাধারণ। হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি পবিত্র স্থান ও উপসনালায়। শ্রী রাম সুন্দর ভট্টাচার্য  মহাশয় মন্দির স্থাপনপূর্বক শ্রী শ্রী মা  মাতাঙ্গী  দেবীর সেবা ও পূজা আরম্ভ করেন প্রায় ২৫০ বছর পূর্বে। পর্যায়ক্রমে অনেকেই এই মন্দিরের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে অমূল্য চরণ চক্রবর্তীর পুত্র সাধন চক্রবর্তী দায়িত্ব পালন করছেন। এই মন্দিরের নিয়মিত  দুই বেলা পূজা -অর্চনা করা হয়।  মন্দিরে প্রত্যহ অসংখ্য ভক্তের সমাগম ঘটে। প্রতিবছর এ মন্দির প্রাঙ্গনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন উৎসব, শ্যামা পূজা, বিশ্বকর্মা পূজা, দুর্গাপূজা,  জন্মাষ্টমী, সরস্বতী পূজা, জগন্নাথ দেবের পূজা ও ধর্মসভাসহ বিবিধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

সাত মন্দির:
এই মন্দির ছাগলনাইয়ার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন। ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার পশ্চিম ছাগলনাইয়া গ্রামে এটি অবস্থিত। মন্দিরটি অপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত একটি স্থাপনা; যা স্বচক্ষে না দেখলে উপলব্ধি করা যাবেনা। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি যখন সংকটময় মুহুর্ত অতিক্রম করছে, তখন এক হিন্দু জমিদার এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করে।

জগন্নাথ কালী মন্দিরঃ এই মন্দিরটি ছাগলনাইয়া উপজেলায় অবস্থিত। শমসের গাজীর বাল্যকালে তাঁর লালন কর্তা জগন্নাথ সেনের স্মৃতির স্মরণে এই মন্দির ও কালী মূর্তি নির্মাণ করেন।

শীলপাথর : ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠান নগর ইউনিয়নের মধ্যম শিলুয়া গ্রামে এই শিলা খন্ডটির অবস্থান। প্রাচীন শিলামূর্তির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের কারণে এই স্থানটি সে সময় থেকেই শিলুয়া  নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রাচীনকালে এই স্থানে বৌদ্ধ ধর্ম ও কৃষ্টির বিকাশ ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়।
হাজার বছরের  প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন এই শীল পাথরের ধ্বংসাবশেষ । শিলা পাথরটির গায়ে খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় অব্দে প্রচলিত ব্রাক্ষ্মী লিপির চিহ্ন পাওয়া যায়। এরপর থেকে এখানে শিকারী আর্য জাতির পদাচরণের প্রমাণ পাওয়া যায় বলে ধারণা করা হয়। তৎকলীন সময়ে এখানে জন বসতি  ছিল। যদিও তেমন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি ।

ফেনী নদী : বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্ত: সীমান্ত নদী।  ১৫৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এবং ১৫৯ মিটার গড় প্রস্থের সর্পিলাকার নদীটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ফেনী, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলা দিয়া প্রবাহিত। উৎসমূল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ফেনী নদীর দৈর্ঘ্য  ১১৫. ৮৫ কিলোমিটার। ছোট ফেনী নামে পরিচিত জেলার মুহুরি নদী ফেনী নদীর মোহনায় এসে মিলিত হয়েছে। এই নদীতে নৌকা ভ্রমণ, দুই তীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জেলেদের মাছ ধরার নান্দনিক দৃশ্য  উপভোগ করা যায়।  

মুছাপুর ক্লোজার:
নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নে বঙ্গোপসাগর ও ফেনী নদীর মোহনায় নির্মিত মুছাপুর ক্লোজার একটি মিনি কক্সবাজার বা মুছাপুর সমুদ্র সৈকত হিসেবে সুপরিচিত। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে মুছাপুর ক্লোজার অন্যতম প্রিয় গন্তব্য। নৈসর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশ, নদীর বুকে সুর্যাস্থের দৃশ্য, জোয়ার-ভাটা এবং জেলেদের কর্ম ব্যস্থতা আগত দর্শনার্থীদেরকে বিমুগ্ধ ও মনোরঞ্জন করে । মুছাপুর ক্লোজার এলাকায় ফেনী নদীর বেলাভূমি যেন কোন এক অনন্য সুন্দর  সাগর সৈকত।

ক্লোজারের চরের মধ্যে প্রায় তিন হাজার একর ভূমি জুড়ে রয়েছে সবুজ বৃক্ষের বনাঞ্চল-মুছাপুর ফরেস্ট ; যা ১৯৬৯ সালে পরিকল্পিতভাবে চালু করা হয়।  এই বনাঞ্চলে রয়েছে আকাশমনি, ঝাউ, পিটালী, কেওড়া, লতাবল, গেওয়া, শনবলই, ইত্যাদি বৃক্ষরাজির সমাহার এবং নানা প্রজাতির দেশীয় পশুপাখির অবাধ বিচরণ। ফলে নদী, সমুদ্র সৈকত এবং জীববৈচিত্রপূর্ণ বনাঞ্চলের মেলবন্ধনে মুছাপুর ক্লোজার ভ্রমণপিপাসু  পর্যটকদের জন্য একটি আকাঙ্ক্ষিত অবকাশ কেন্দ্র।


বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল : বঙ্গোপসাগরের বেলাভূমি থেকে অদূরে  মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও সোনাগাজীর  কোল ঘেঁষে বিস্তৃত এলাকা নিয়ে এশিয়ার এই  বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল  বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল নামে গঠিত। এই বিস্তৃত এলাকার আয়তন ৩৩,৮০০  একর। পুরোদমে চালু হলে  এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং  মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীতে  আর কোন বেকার থাকবে না। চলতি বছরই কয়েকটি কারখানায় উৎপাদন শুরু হতে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী  ও পর্যটকদের পদচারণায় সরব ও  কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে। এ অঞ্চলে পর্যটন শিল্প বিকাশের অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রবাসী ও ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদেরকে পর্যটন খাতে  বিনিয়োগের জন্য আহ্বান করা যেতে পারে।

উপসংহারে, উল্লেখ্য যে ফেনী জেলা পর্যটন সম্পদে  সমৃদ্ধ। ফেনীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও  শিক্ষার পরিবেশ স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ। ফেনীর উন্নয়ন চলমান। লালপুর ফ্লাইওভার ও লালপুল থেকে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল পর্যন্ত  ফোর লেইন রাস্তা চালু হলে ফেনী জেলার সর্বস্তরের মানুষের জীবন ও কর্মের উপর ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। মানুষের জীবন হয়ে উঠবে ভীষণ ব্যস্ত ও কর্মচঞ্চল। ফলে, ফেনী হবে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন শহর।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী ও পর্যটন বিশেষজ্ঞ।




ফিচার - এর আরো খবর

মৌমাছির সঙ্গে সখ্যতা হৃদয়ের

মৌমাছির সঙ্গে সখ্যতা হৃদয়ের

১৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০৮:০৪ পূর্বাহ্ন

বিশ্বের বৃহত্তম গালিচার মসজিদ

বিশ্বের বৃহত্তম গালিচার মসজিদ

১৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০৮:০৪ পূর্বাহ্ন

ফেনী হবে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন জেলা

ফেনী হবে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন জেলা

১৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০৮:০৪ পূর্বাহ্ন

সাহসী নারীর গল্প

সাহসী নারীর গল্প

১৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০৮:০৪ পূর্বাহ্ন

গাছের ছায়ায় বই পড়ার দারুণ ট্রেন্ড

গাছের ছায়ায় বই পড়ার দারুণ ট্রেন্ড

১৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০৮:০৪ পূর্বাহ্ন