মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করাই মানুষের ধর্ম। আর পরিবার হচ্ছে আদিম যুগের আদিম প্রতিষ্ঠান, মানবসভ্যতার মৌলিক প্রতিষ্ঠান, সৌহার্দ্য-ভালোবাসার বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। অস্তিত্বের প্রয়োজনে আদিম যুগে মানুষের মধ্যে সংঘবদ্ধভাবে বাস করার প্রবণতা ছিল।
এক সময় গ্রাম বা শহরে অনেক যৌথ পরিবার দেখা যেত। মানুষের পুকুরভরা মাছ ছিল, ক্ষেতজুড়ে ধান ছিল, গোয়ালভরা গাভি ছিল। যৌথ পরিবারে অনেক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। অবস্থাভেদে প্রতিটি পরিবারে সদস্য ছিল ২০ থেকে ৩০ জন। কোথাও বা এর চেয়ে বেশি। পরিবারের কর্তার আদেশ সবাই মেনে চলত। ভাই-বোনের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকত। বিয়ে বিচ্ছেদ হতো কম। পৃথিবী যত এগিয়ে যাচ্ছে, যৌথ পরিবার তত কমে যাচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারের সুবিধা, ঐতিহ্য; সেই সঙ্গে ভেংঙ্গে যাচ্ছে সামাজিক বন্ধন।
ছোট বেলায় দেখেছি গ্রামের সকল মানুষ সামাজিক কৃষ্টি পালনে বাড়ির উঠোনে, পুকুর পাড়ে বা স্কুলের মাঠে বসে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এখন সেই বসা হয় গ্রামের বা হাট বাজারের কোন ব্যক্তির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। একজনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে অন্যজন স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে সামান্যতম হলেও সংকোচবোধ করতেই পারে। আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসা মানেই ক্ষমতা জাহির করা। গ্রামের স্কুল মাঠ বা পুকুর ঘাটের খোলা বাতাস গায়ে লাগিয়ে মানুষ থাকে প্রানবন্ত। সেখানে ছোট বড় ধনী গরীব বিচারে নয় অভিজ্ঞতার আলোকে আলোচনা, মতামত এবং সিদ্ধান্ত হয়। তারই ভিত্তিতে গ্রামের সকল মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামাজিক এই কর্মকান্ডগুলো সম্পন্ন করে। এই কাজে থাকে না ভেদাভেদ, থাকেনা কোন স্বার্থ। পরিবারে পরিবারে এক সেতুবন্ধন ছিলো সামাজিক এই অনুষ্ঠান গুলো। গ্রামে গ্রামে মজলিশ আর হয় না। এই মজলিসে মূলত গ্রামের সবাই একত্রিত হত খাওয়া-দাওয়া করত গ্রামের সবাই একসাথে। আশেপাশের গ্রামের মানুষেদেরও দাওয়াত দেয়া হতো। কতজনকে কত ভালো খাওয়ানো যায় এরকম একটা মানসিক প্রতিযোগিতা দেখা যেতো এই ২০-৩০ বছর আগেও। এখন গ্রামে গ্রামে এসব হয় না। যা ও দু একটা হয় সেখানে কত কম খাইয়ে নিজের পকেট ভরানো যায় সেই চেষ্টাতেই ব্যস্ত থাকে সবাই। টাকার ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও আছে অনেক। এখন এই পর্বগুলোকে তারা তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করছে। এই সামাজিক অনুষ্ঠানও এখন হয়ে গেছে বানিজ্যিক।
মানুষের পবিত্র আশ্রয়ের অদ্বিতীয় এ সংগঠনটি ভেঙে যাচ্ছে ঠুনকো কারণে, মাঝে মাঝে তা হয়ে উঠছে রণক্ষেত্র। পারিবারিক বন্ধন আলগা হয়ে যাওয়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে পারিবারিক অস্থিরতা ও সহিংসতা, যা নিশ্চিতভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে সংক্রমিত হচ্ছে। বলতে গেলে আজ বিশ্বব্যাপী যে অস্থিরতা তার শিকড় গ্রথিত এই পারিবারিক অস্থিরতায়।
একান্নবর্তী পরিবারের বদলে এখন ফ্ল্যাটভিত্তিক পরিবারের বিকাশ ঘটেছে। সচরাচর বাবা-মায়ের স্থান হয় না এসব ফ্ল্যাট পরিবারে। আগে যেসব কাজকে পারিবারিক কাজ হিসেবে গণ্য করা হতো এখন তা পরিবারের বাইরেই হয়। কারও অসুখ হলে পারিবারিক সেবার চেয়ে হাসপাতালকে দেয়া হয় প্রাধান্য। উপার্জন অক্ষম সদস্যকে পারিবারিক বন্ধনের বাইরে রাখার প্রবণতা বিপজ্জনক হারে বাড়ছে।
কাজেই সব সমস্যার সমাধান যদি আমরা পারিবারিক বা সামাজিকভাবে শুরু করি তাহলে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ গঠনে সহায়ক হবে। সামাজিক অসংগতি দূর হবে, ধনী-গরীবের বৈষম্য দূর হবে, সবার সঙ্গে সবার ভালবাসা তৈরি হবে, সব ধরনের গুজব দূর হবে, যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় লড়তে সহজ হবে। গড়ে তোলা সম্ভব হবে সুখি সমৃদ্ধশালী একটি সোনার বাংলাদেশ।