যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে যাবজ্জীবন সাজা খাটছে নুরজালাল মোল্লা নামে নয় বছরের এক শিশু। ইতিমধ্যে কারা প্রকোষ্টে তার কেটে গেছে ২০ বছর। বর্তমানে তিনি ২৯ বছরের যুবক। মা-বাবাহীন নুরজালাল মোল্লার দেখার কেউই নেই। ২০০৪ সালে তৎকালীন বিডিআরের দেয়া এক মামলায় জেল খাটছে নিরপরাধ এই শিশু। তখন তার বয়স ছিল নয় বছর।
সাজাপ্রাপ্ত নুরজালালের পিতার নাম সুলতান মোল্লা। বাড়ি মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার বুনোগাতি গ্রামে।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে নুরজালাল তার জীবনের করুণ পরিণতির বিবরণ তুলে ধরেন।
এরপর তার মামলা সংক্রান্ত কাগজপত্র উদ্ধার করেন যশোরের দুই সংবাদকর্মী। মামলার নথিপত্রে পাওয়া জন্ম সনদ ও করোনার টিকা কার্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কারাগারে আটক নুরজালালের জন্ম তারিখ ১৯৯৫ সালের পহেলা জুন। ২০০৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তার বয়স ছিল ৯ বছর ৩ মাস ১১ দিন।
কারাগারে আটক নুরজালাল জানিয়েছেন, তার বয়সী তিন শিশু ট্রেনে ট্রেনে ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। ২০০৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনিসহ আরও দু’শিশু দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরের রেলস্টেশনে নামেন। এরপর কাগজ কুড়াতে কুড়াতে নোম্যান্সল্যান্ডের দিকে যেতে থাকেন তারা। তখন সেখানে দায়িত্বরত বিডিআরের এক সদস্য তাদের ডাকেন। দু’শিশু সাথে সাথে গেলেও কাগজের বস্তা নিয়ে যেতে দেরি হয় নুরজালালের। এ কারণে বিডিআরের ওই সদস্য তাকে বেধড়ক মারপিট করেন। এরপর বিডিআর দিনাজপুরের হাকিমপুর থানায় তিন শিশুর নামে মামলা দেয়। জিআর মামলা নম্বর ৭৩২/০৪। কিন্তু মামলায় দু’শিশুর বয়স উল্লেখ করলেও অজ্ঞাত কারণে নুরজালালের বয়স উল্লেখ করা হয়নি। আহত অবস্থায় তাদেরকে থানায় দিতে চাইলে তৎকালীন ওসি তাদেরকে থানায় রাখতে চাননি। তখন বিডিআরের হাবিলদার আব্বাস আলী কিছু ওষুধ দিয়ে তাদের থানায় রেখে যান। এরপর পুলিশ ওই তিন শিশুকে আদালতে সোপর্দ করে। আদালত তাদের কারাগারে পাঠালে কারা কর্তৃপক্ষ শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে ওইদিনই কারা হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে দীর্ঘ ১৩ মাস চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয় তারা। এরপর মামলায় দু’শিশুর বয়স উল্লেখ থাকায় তারা জজ কোর্টে কিশোর আইনে জামিনে বের হয়ে যায়। ওই দু’শিশুর জামিনের সাত মাস পর নুরজালালকে আদালতে তোলা হলেও মামলায় বয়স না থাকায় জামিন হয়নি। একপর্যায়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওই দু’শিশুকে সাক্ষী বানিয়ে শিশু নুরজালালের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেন।
দীর্ঘ তিন বছর হাজতি হিসেবে কারাগারে থাকার পর দিনাজপুর জজকোর্টে শিশু নুরজালালের যাবজ্জীবন সাজা হয়। সাজা হওয়ার পর জেলসুপারের মাধ্যমে আপিল করে শিশু নুরজালাল। কিন্তু মামলায় বয়স উল্লেখ না থাকায় আপিলেও তার সাজা বহাল থাকে।
ইতিমধ্যে সাজার ২০ বছর পার হয়েছে শিশু নুরজালালের। তার বয়স এখন ২৯। সাজার পর তাকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।
কাঁদতে কাঁদতে নুরজালাল বলেন, ‘২০ বছর সাজা খাটার পর অনেক বন্দিকে ৫৬৯ ধারায় খালাস দেয়া হয়েছে। অথচ আমি বিনা অপরাধে ২০ বছর সাজা খাটার পরও কিশোর আইন কিংবা ৫৬৯ ধারায় মুক্তি পাইনি। আমি কারাগারে যাওয়ার আগে মা মারা যান। কারাগারে থাকা অবস্থায় মারা যান বাবাও। এ কারণে আমার জন্য তদবিরের লোক নেই।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নুরজালাল বলেন, ‘বিভিন্ন দিবসে অনেক বন্দি মুক্তি পায়। নয় বছর বয়স থেকে কারাগারে আছি। এরমধ্যে ২০ বছর কেটে গেছে। আর সহ্য করতে পারছিনে। আমার মামলার কাগজপত্র পর্যালোচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি চাই। নয় বছর বয়সে আমি এমন কোনো অপরাধ করিনি যে যাবজ্জীবন সাজা খাটতে হবে। তারপরও আমার জীবন থেকে ২০টি বছর চলে গেছে কারাগারে। মানবিক দিক বিবেচনা করে আমাকে মুক্তি দেয়া হোক।’