ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর রাজধানীর লালবাগের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রম তদন্ত করে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের মালামাল খোলা বাজারে বিক্রি করার অভিযোগ করে প্রায় ২৭৫.৩২ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন করেছে। একইসাথে চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি সংক্রান্তে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও আয়কর ফাঁকির অভিযোগ তদন্তের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটি হলো ঢাকার লালবাগের বকশিবাজার ৩৬-৩৭ উমেশ দত্ত রোডে অবস্থিত নাহিদ এন্টারপ্রাইজ। এর নিবন্ধন: ০০০৩৮১০৯২-০২০৪। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্ত্বাধিকারী জনাব আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন, পিতা- কাইয়ুম, মাতা-হামিদা খাতুন, ঠিকানা- ১০/এ, গির্দা উর্দু রোড, পোস্তা, লালবাগ, ঢাকা-১২১১।
সূত্রমতে, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির একটি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ভ্যাট গোয়েন্দা দপ্তরের অনুসন্ধান কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে এই অনুসন্ধানের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানটির জুলাই/ ২০১৫ হতে জুন/ ২০২০ সময়ের ভ্যাট সংক্রান্ত দলিলাদি চেয়ে কয়েকবার পত্র প্রেরণ করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ উক্ত অনুসন্ধানের জন্য দলিলাদি প্রেরণ না করে পত্র মারফত বারবার সময়ে চেয়ে কালক্ষেপণ করে। প্রতিষ্ঠানটি দলিলাদি দাখিল করে তদন্ত কাজে সহযোগিতা না করায় প্রতিষ্ঠানটিতে গত ১৭ জুন ভ্যাট গোয়ন্দা দপ্তরের উপ-পরিচালক তানভীর আহমেদের নেতৃত্বে নিবারক কার্যক্রম চালিয়ে ভ্যাট সংক্রান্ত বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করা হয়।
অনুসন্ধানে আরো দেখা যায় যে, মেসার্স নাহিদ এন্টারপ্রাইজ অন্যান্য বন্ডেড প্রতিষ্ঠান থেকেও বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত ছিল। এর ফলে চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি সংশ্লিষ্ট মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মর্মে অনুসন্ধান টিমের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
উক্ত প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট গোয়েন্দার অভিযানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মূসক-৬.৩ চালান ব্যতীত সেবা প্রদান করে যথাযথ রাজস্ব পরিশোধ না করে প্রকৃত বিক্রয় তথ্য অন্যত্র গোপন দলিলে সংরক্ষণ করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছে।
তদন্ত মেয়াদে জুলাই/২০১৬ থেকে মে/২০২১ পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর প্রতিষ্ঠানটি দাখিলপত্রে বিক্রয়মূল্য প্রদর্শন করেছে ২৯১,৮৯,০০,০৬৬ টাকা; কিন্তু জব্দকৃত দলিলাদির ভিত্তিতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত বিক্রয়মূল্য ১৫৪০,২৬,৬৩,০২২ টাকা, যার মধ্যে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রয়মূল্য ছিল ১৩৩৯,৩৬,২০,০১৯ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি ১০৪৭,৪৭,১৯,৯৫৪ টাকার প্রকৃত বিক্রয়মূল্য গোপন করেছে। বিক্রয়মূল্য কম প্রদর্শন করায় অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ১৫৭,১২,০৭,৯৯৩ টাকা উদঘাটন করা হয়, যার উপর মাস ভিত্তিক ২% হারে ১১৮,১৯,৯৪,২৪২ টাকা সুদসহ মোট ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ২৭৫,৩২,০২,২৩৫ টাকা।
এখানে উল্লেখ্য যে, এই প্রতিষ্ঠানটি উক্ত ৫ বছরে দাখিলপত্রের মাধ্যমে মোট ভ্যাট পরিশোধ করেছে ৪৩,৭৮,৩৫,০১০ টাকা।কিন্তু ভ্যাট গোয়েন্দার তদন্তে একই সময়ে ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ পাওয়া যায় ১৫৭.১২ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি হওয়ায় স্পষ্ট হয় যে, প্রতিষ্ঠানটি নানা ধরণের অবৈধ লেনদেনের সাথে জড়িত হয়েছে।
এই তদন্তে প্রতিষ্ঠানের দুটো ব্যাংক এ্যাকাউন্টে মোট ১৫৪০,২৬,৬৩,০২২ টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।অবৈধ বন্ডেড পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের অর্থ এইসব লেনদেনে সংঘটিত হয়েছে মর্মে তদন্তে উঠে এসেছে।প্রতিষ্ঠানের নামে প্রাইম ব্যাংক এর মৌলভিবাজার শাখা ও উত্তরা ব্যাংক এর চকবাজার শাখায় দুটো ব্যাংক এ্যাকাউন্ট রয়েছে।

বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের পণ্য যথাযথভাবে ঘোষণা না দিয়ে খোলাবাজারে ক্রয়-বিক্রয় করা ভ্যাট ও কাস্টমস আইন অনুসারে অপরাধ। ভ্যাট আইনের পাশাপাশি কাস্টমস আইনের অপরাধ যথাযথভাবে তদন্ত ও প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এখতিয়ার সম্পন্ন হওয়ায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরকে এবিষয়ে অনুরোধ করা হয়েছে । অন্যদিকে, ভ্যাট গোয়েন্দার অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ভ্যাট ফাঁকির সংশ্লেষে আয়কর ফাঁকির অভিযোগটি আরো গভীরভাবে তদন্ত ও ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)-কে অনুরোধ করা হয়েছে।
তদন্তে উদঘাটিত পরিহারকৃত ভ্যাট আদায়ের আইনানুগ পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে মামলাটি সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারেটে প্রেরণ করা হয়েছে।একইসাথে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আরো মনিটরিং করার জন্যও সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারকে অনুরোধ করা হয়েছে।অন্যদিকে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ঢাকা বন্ড কমিশনারকেও অনুরোধ করা হয়েছে।