বিপন্ন পরিবেশ, বিপন্ন জনজীবন । বাংলাদেশে পরিবেশদূষণ সব সীমা ছাড়িয়ে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় ছাড়াও অধিদপ্তর ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ রয়েছে, যারা সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। এসব সংস্থার জনবলও কম নয়। তারপরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন? সমস্যা হচ্ছে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাব।
করোনা'র কারণে আমাদের জীবন, সারা পৃথিবীর মানুষের জীবন সংকটাপন্ন, সেই সময়ে পরিবেশের জন্য সারা পৃথিবীতে কাজ চলছে। সেক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়,কর্মকর্তারা কী করছেন?
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী প্রফেসর ড. শামসুল আলম জানান, ‘রুপকল্প ২০২০-৪১ বাস্তবায়নসহ পরিবেশ রক্ষায় নানা ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। পরিবেশ রক্ষায় ডেল্টাপ্ল্যান বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। পরিবেশ রক্ষার্থে সরকারকে সহযোগিতা করার কথাও জানান তিনি।তিনি বলেন সচেতনতা ও সকলের সহযোগী মানসিকতা পরিবেশ রক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য আনতে পারে।
তাছাড়া পরিবেশ বাঁচানোকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে পঞ্চাশটির মতো বেসরকারি সংগঠন, সামাজিক সংগঠন ও এনজিও রয়েছে। তারাও বা কী ভূমিকা রাখতে পেরেছেন? কী করছেন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো?
এমন প্রশ্ন জনমনে।
প্রসঙ্গত আমরা যে পরিবেশে বাস করি তা প্রতিমুহূর্তেই দূষিত হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কলকারখানা ও যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। এগুলো বেশি পরিমাণে বিষাক্ত বাষ্প ও কার্বন মনোক্সাইড উ’পাদন করে বায়ু দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি আমরা যে ভূমিতে বিচরণ করি তাও ময়লা আবর্জণায় দূষিত। শিল্পবর্জ্য, বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ও অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থের মাধ্যমে পানি দূষিত হয়। বন-জঙ্গল ও গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে আর এভাবে পারিপার্শ্বিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। মোটরযান, উড়োজাহাজ, গৃহস্থালির যন্ত্রপাতি ইত্যাদি থেকে শব্দ দূষণ হয়। যা অন্যান্য দূষণ থেকে কম ক্ষতিকর নয়। আমরা দূষণ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে না পারলেও এটি ব্যাপক অংশে কমাতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এটি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেফ গ্রহণ করা এখন সময়ের দ্বাবি। সেই সাথে বর্তমান ও অনাগত আগামী প্রজন্মের জন্য মুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার বিকল্প কিছু নাই।
বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশে বিগত ৫ বছরে মারা গেছে চার লক্ষাধিক মানুষ।যারা দূষিত পরিবেশের কারণে নানা অসুখে ভূগে মৃত্যু বরণ করেছেন।
বিশ্ব ব্যাঙ্ক আরো বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর যতো মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখবিসুখের কারণে। কিন্তু সারা বিশ্বে এধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ।
সেক্ষেত্রে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের কারণে এ দেশের মানুষের মৃত্যুঝুকি অপেক্ষাকৃত বেশি।
গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, ৭ থেকে ৮ প্রবৃদ্ধির একটি উচ্চতর মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে উঠতে হলে বাংলাদেশকে এখনই, বিশেষ করে শহর এলাকায় দূষণ রোধ করতে ও পরিবেশ রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে হবে।
দূর্ভাগ্যজনক সত্যি বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ, প্লাস্টিকদূষণ-সব ধরনের পরিবেশদূষণ বাংলাদেশকে আঁকড়ে ধরেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। কোনো প্রতিকার নেই, দূষণ বেড়েই চলেছে। দেশের মানুষ বেঁচে আছে অসহায় অবস্থায়।
বিশেষ করে শহর এলাকার কলকারখানা বর্জ্য, ড্রেনেজ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা ও দৈনন্দিন রাস্তায় চলমান যানবাহনের ক্ষতিকর ধোঁয়া, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ইট ভাটার ধোঁয়া যা মানুষের ফুসফুসের ক্ষতি করছে।
মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পরছে বলে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক রোগ বিভাগের চিকিৎসক ডাক্তার সালাউদ্দিন কাওসার বিপ্লব। তিনি বলেন ইনসমনিয়া,মেন্টাল ডিস অর্ডার সহ নানাবিধ মানসিক সমস্যার জন্য দূষিত পরিবেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করছে।
দেশের প্রতিটি জেলাতেই বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি। গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে বায়ুর মান তুলনামূলকভাবে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। রাজধানী ঢাকার বায়ুর মান সবচেয়ে বেশি অস্বাস্থ্যকর। বিশ্বের খারাপ বায়ুর মানের তালিকায় প্রায়ই ঢাকা শীর্ষস্থানে চলে যায়। অন্য সময় দুই বা তিন নম্বরে থাকে।
বিভিন্ন গবেষণায় বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হিসাবে যেসব উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ইটভাটা, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প-কারখানা, যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া, বিভিন্ন নির্মাণকাজের ধুলা, সমন্বয়হীন সংস্কারকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, শহরের বর্জ্য উন্মুক্ত জায়গায় পোড়ানো, নিম্নমানের কয়লা ও তরল জ্বালানি ব্যবহার ইত্যাদি। কারণগুলো যেহেতু চিহ্নিত, তাহলে তা দূর করা যাবে না কেন? এটা করতে পারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এর জন্য প্রথমেই গুরুতর এ সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করা এবং সমস্যা সমাধানে আন্তরিক উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা জানান
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ও পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।
"তিনি বলেন,মানুষকে বাঁচতে হলে পরিবেশ বগে বাঁচাতে হবে কারন অসুস্থ পরিবেশে সুস্থ জীবন আশা করা যায় না।"
এরপর রয়েছে সরব ঘাতক শব্দদূষণ।অনেকে শব্দদূষণকে শব্দসন্ত্রাস নামে আখ্যায়িত করেন। কৃত্রিম বা যান্ত্রিকভাবে সৃষ্ট শব্দ যখন মাত্রা অতিক্রম করে তখন পরিবেশ দূষিত হয়, মানুষের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন বিশেষজ্ঞের অভিমত-‘শব্দদূষণের মতো সরব ঘাতক আর নেই। সাধারণভাবে আমরা যে শব্দ চাই না, সেটাই শব্দদূষণ। মানুষ ও প্রাণীর শ্রবণসীমা অতিক্রম করে এবং শ্রবণশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সে শব্দকেই শব্দদূষণ হিসাবে জেনে থাকি।’
বিশ্বের বাসযোগ্য শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান তলানিতে। এর অন্যতম প্রধান কারণ শব্দদূষণ। এ দূষণ এখন ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নেই, উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কারণ দেশে মোটরগাড়ি ও যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে। প্রতিদিন শত শত নতুন গাড়ি রাস্তায় নামছে। এত গাড়ির কারণে যানজট বাড়ছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শব্দদূষণ। প্রতিটি গাড়ি ও যান্ত্রিক বাহন কারণে-অকারণে তীব্র মাত্রায় হর্ন বাজাতে থাকে। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
এখন আবার রাস্তায় হাজার হাজার মোটরবাইক দেখা যায়। এগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে সস্তা ও সহজলভ্য। তরুণ-যুবকরাই এগুলোর চালক। ঢাকাবাসী নিশ্চয়ই দেখেছেন তরুণ-যুবকরা তীব্র শব্দ সৃষ্টি করে দ্রুতগতিতে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায় এরা দল বেঁধে উদ্দাম গতিতে বাইক চালাচ্ছে শহরের রাস্তায়। এরা কারা সহজেই অনুমেয়। ট্রাফিক পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষও যেন এদের ব্যাপারে নির্বিকার। শুধু ঢাকা নয়, অন্যান্য শহরেও একই চিত্র।
ঢাকা মহানগরীর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং অন্যান্য শহরাঞ্চলে মাইকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বা অপব্যবহার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ফুটপাতের হকার এবং রাস্তায় চলমান হকাররাও রিকশা অথবা ভ্যানগাড়িতে মাইক লাগিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাজাতে থাকে বিনা বাধায়। আমার জানামতে, মাইক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন আছে। যে কোনো অনুষ্ঠানে বা যে কোনো প্রয়োজনে মাইক ব্যবহার করতে হলে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এ আইনের প্রয়োগ কোথায়!এখন কি আইনটি বাতিল বা স্থগিত হয়ে গেছে?কর্তাব্যক্তিরাও কেনো নীরব! শুধু অসহায়ভাবে দেখছি যে, মাইকের অবাধ অপব্যবহার চলছে বলে জানান শনির আখরার স্থায়ী বাসিন্দা নুরুল হক খোকন। তিনি আমাদের কন্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদক আমিনুল ইসলাম আমিনকে জানান তাদের অসহায়ত্বের কথা। বিভিন্ন বনাজী কবিরাজি ঔষধ বিক্রির নামে দিন রাত চলছে মাইক। মাইকের শব্দে মানুষ রাস্তায় দ্বাড়াতে পারেনা। অলিগলিতেও এখন মাইকের প্রখর শব্দে লেখাপড়া করতে পারে না শিক্ষার্থীরা। এমনকি ঘুমাতেও পারে না মানুষ।
শ্রবণশক্তি তো ইতোমধ্যেই আরও অনেকের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে।
সম্প্রতি গুলিস্তানের প্রতিদিনের অবাধ শব্দ দূষণের সাথে যোগ হয়েছে দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহনের বিভিন্ন ব্যানারের গাড়ির কাউন্টারগুলোতে হ্যান্ডমাইক দিয়ে যাত্রী ডাকা। হঠাৎ করে বিভিন্ন এলাকার নামে বিশ পঁচিশ জন যাত্রী ডাকতে থাকে বিরামহীনভাবে।
গুলিস্তান দোলা পরিবহন,ইমাদ পরিবহন, পালকি এক্সপ্রেস, সেবা গ্রীণলাইন সহ বেশ কয়েকটি কাউন্টারের সামনে এমন চিত্র দ্যাখা যায়।জিজ্ঞেস করা হলে সুমন নামের একজন বলেন,"ভাই গলা ভাইঙা যায় তাই এটা দিয়ে ডাকছি!"
শব্দ দূষণ ও পাবলিকের ক্ষতি করছেন কেনো এমব প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে ডাকা বন্ধ করে চলে যান সুমন।
আনিস ও ঝুমুর দম্পত্তি তাদের ছয় বছরের মেয়ে বুবলিকে নিয়ে খুলনা যাচ্ছেন। এমন বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে আনিস জানান,নিঃসন্দেহে এই অব্যবস্থাপনা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে।
পরিবেশদূষণও এক ধরনের সন্ত্রাস ও সহিংসতা। একে কাঠামোগত সহিংসতা (structural violence) হিসাবে বর্ণনা করেছেন পরিবেশবিধ,শিক্ষক, চিকিৎসক, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সহ নানা শ্রেণির বিশিষ্টজন। এই সহিংসতার অবসান ঘটিয়ে দেশের বিপন্ন মানব প্রজাতিকে রক্ষা করা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতি অবশ্যই হচ্ছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতিই শেষ কথা নয়। বেঁচে থাকার পরিবেশ সৃষ্টি ও রক্ষা করাই বড় কথা। অসুস্থ পরিবেশে সুস্থ জাতি গড়ে উঠতে পারে না বলে মত পোষণ করেন তারা।