তিন মাসে প্রায় সাড়ে চার হাজার নার্স বদলি করে রেকর্ড গড়েছে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর। গত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এসব বদলির ঘটনা ঘটে। অভিযোগ উঠেছে, এই বদলিবাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রায় শতকোটি টাকা। আর এতে কয়েক দালালের পাশাপাশি জড়িত আছেন অধিদপ্তরের উচ্চপর্যায়ের দু-একজন কর্মকর্তাও। আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
নার্সিং অধিদপ্তর এবং নার্সিং সেক্টরের একাধিক কর্মকর্তাজানান, মহামারীতে রোগীদের সেবা দিতে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অনেক নার্স বদলি করতে হয়েছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বদলিবাণিজ্যে মেতে ওঠেন। এ ক্ষেত্রে নার্সদের পাশাপাশি ফেসবুক পেজ কাজে লাগানো হয়েছে। প্রতি বদলিতে ২ লাখ ২০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। বদলির জন্য অনেক নার্সকে গুনতে হয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকাও। বদলির ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও মানা হয়নি। বদলির জন্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, মন্ত্রীর প্রতিনিধি এবং অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের কথা থাকলেও তা করা হয়নি।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে গড়ে ৩শ থেকে ৪শ জনের বদলি হয়। এমনকি গত ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও চলতি ফেব্রুয়ারিতে বদলি হয়েছে ১০০ জনের মতো। বদলির বিষয়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং অতিরিক্ত সচিব সিদ্দিকা আক্তারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। গত সোম ও মঙ্গলবার অধিদপ্তরে গিয়েও পাওয়া যায়নি তাকে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, বদলি সিন্ডিকেটের একজনের নাম মো. জামাল উদ্দিন। এই কাজে তিনি বিভিন্ন ব্যাংকের ৯টি ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে চারটি কুষ্টিয়ায়। তিনটি ব্যাংক হিসাব দনিয়া শাখায়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জেও তার ব্যাংক হিসাবের খোঁজ পাওয়া গেছে। এ সংক্রান্ত নথিপত্র আমাদের সময়ের হাতে রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জামাল উদ্দিনের স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে ৭ মাসে জমা হয়েছে ৭২ লাখ টাকা। বাড়ি কুষ্টিয়া হলেও জামাল থাকেন ঢাকার শনিরআখড়া এলাকায়। জামালের দূরসম্পর্কের চাচা কমল, যিনি স্ত্রীর দিক থেকে নার্সিংয়ের এক কর্মকর্তার আত্মীয়। সেই সম্পর্কের জের ধরেই গড়ে তোলেন বদলি সিন্ডিকেট। নার্স বদলির এই সিন্ডিকেট সারাদেশে তাদের জাল বিস্তার করে রেখেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা কমপ্লেক্স শাখায় জামালের সঞ্চয়ী হিসাব নাম্বার ৩০১৬৩০১০১৩০৮১। সারাদেশ থেকে টাকা জমা পড়ে এই হিসাবটিতে। গত ২৭ জুলাই থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত এই হিসাবে ২১টি জেলার প্রায় ৪২টি শাখা থেকে ৬০ বার টাকা জমা হয়। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে- রাজবাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, হবিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নীলফামারী, পাবনা, নরসিংদী, ঢাকা, জয়পুরহাট. বরিশাল, কিশোরগঞ্জ, রংপুর, চট্টগ্রাম, পিরোজপুর, মৌলভীবাজার, সৈয়দপুর, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, রাঙ্গামাটি ও বগুড়া। চার মাসে এসব জেলা থেকে হিসাবটিতে ১ কোটি ৮০ হাজার ৫১৩ টাকার বেশি লেনদেন হয়। সর্বশেষ তথ্যা অনুযায়ী, ওই হিসাবে ৩৮ লাখ ২১ হাজার ৪৪৬ টাকা জমা ছিল। অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে মো. জামাল উদ্দিনের দুটি মোবাইল ফোনে কয়েকবার চেষ্টা করা হয়। তবে দুটি নাম্বারই বন্ধ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ময়মনসিংহ-সিলেটের বদলির তদবির করেন দুজন। একজন সিলেটের বিএনএ নেতা; আরেকজন এক নার্সিং কমর্কতার ভাই; যিনি ওই এলাকার একটি পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। বিএনএর ওই নেতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। এ ছাড়া সিন্ডিকেটের কুমিল্লার সদস্য একজন, খুলনায় একজন, রংপুর ও রাজশাহীতে দুজন, ঢাকা বিভাগের দায়িত্বে দুজন এবং বরিশালে একজন। আর এক গাড়িচালকের তত্ত্বাবধানে ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও বাগেরহাটে সিন্ডিকেট পরিচালিত হতো।
এদিকে অবৈধ বদলিবাণিজ্যের দুর্নীতি তদন্তে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। গত বুধবার মানবাধিকার সংগঠন ‘ল অ্যান্ড লাইভ ফাউন্ডেশনের’ পক্ষে এই নোটিশ পাঠান ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব ও ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মাজেদুল কাদের।