শ্যামসুন্দর সিকদার। একজন পুরোদস্তুর আমলা। বর্তমানে শ্যামসুন্দর সিকদার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে সিনিয়র সচিবের পদমর্যাদায় তিনি এ দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। সিনিয়র সচিব হয়ে ২০১৯ সালের জানুয়ারি এখান থেকে তিনি অবসরে যান।
দীর্ঘ কর্মজীবনে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সমান তালে চলে লেখালেখি। লেখার বিষয়বস্তুও কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। তিনি একজন বহুমাত্রিক লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখায় মানবতা, দেশপ্রেম, সমকালীন জীবন, সমাজ ব্যবস্থা, স্থানীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আকর অসাধারণভাবে ফুটে ওঠেছে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী এবং প্রবন্ধ ইত্যাদি সকল মাধ্যমে তাঁর অবাধ বিচরণ এবং সাহিত্য বিচারে তা সমুজ্জ্বলও বটে। বেশ কিছুদিন তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। দেশ-বিদেশে তার চিকিৎসা চলেছে। তবে তাতেও দমে যাননি। বন্ধ থাকেনি সাহিত্য চর্চা। যার প্রমাণ মিলে এবারের বই মেলায় বরেণ্য এ লেখকের ছয়টি বই শোভা পাবার মধ্য দিয়ে। এগুলো হলো:
আত্মজীবনীমূলক বই 'জীবনের কথা বলি এবার (প্রথম প্রকাশ), কবিতার বই 'দুঃসময়ের নষ্ট কাব্য' (অনন্যা প্রকাশনী) ও ‘জন্ম আমার পাপ নয়' (চারুলিপি প্রকাশন), 'কলিজায় পোড়া দাগ’ (জনপ্রিয় প্রকাশনী), 'চন্দ্রাবতী কাব্য' (মাতৃভাষা প্রকাশন) এবং গবেষণা গ্রন্থ 'বঙ্গবন্ধু ও আগরতলা মামলা: ইতিহাসের নতুন গতিপথ' (মাতৃভাষা প্রকাশ)।
এরমধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু ও আগরতলা মামলা: ইতিহাসের নতুন গতিপথ' গ্রন্থে বাঙালিদের দমিয়ে রাখতে এবং স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে চিরতরে স্তব্ধ করতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির চক্রান্তের নানা বাঁক ফুটে ওঠেছে। প্রকাশকের বর্ণনা মতে, "বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে যুদ্ধ, সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা হচ্ছে তার স্বাধিকার আন্দোলন এবং সে আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন।
২৩ বছরের এ আন্দোলনের নানা চড়াই-উৎরাই, ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক বদল শ্যামসুন্দর সিকদার দেখেছেন কবির সর্বদৃষ্টি দিয়ে। ‘বঙ্গবন্ধু ও আগরতলা মামলা: ইতিহাসের নতুন গতিপথ’ গ্রন্থে তিনি ঐতিহাসিক ওই মামলার বিচার প্রক্রিয়া এবং বঙ্গবন্ধুর বুদ্ধিদীপ্ত যুগান্তকারী ভূমিকায় কীভাবে তিনি নিজেকে এবং বাঙালি জাতিকে রক্ষা করে চুড়ান্ত বিজয়ের পথে পরিচালিত করেছেন, তার একটি বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন সম্পূর্ণ নতুন ও ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে আগরতাল মামলার ওপর অসংখ্য গ্রন্থ লেখা হলেও শ্যামসুন্দর সিকদারের এ গ্রন্থে সর্বস্তরের পাঠক, বিশেষ করে ইতিহাস এবং রাজনীতির অনুসন্ধিৎসু ঐতিহাসিক এ ঘটনা সম্পর্কে নতুন ধারণা লাভ করবে।
প্রসঙ্গত, শ্যামসুন্দর সিকদারের সাহিত্য-জীবন শুরু হয় কবিতা লিখে। ১৯৮৪ সাল থেকে তাঁর নিয়মিত লেখা দেশের প্রখ্যাত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। দৈনিক সংবাদ-এর 'খেলাঘর', বাংলার বাণী, ইত্তেফাক এবং সাপ্তাহিক প্রতিরোধসহ বেশকিছু পত্র- পত্রিকায় তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও তথ্য অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত 'নবারুণ' ও 'সচিত্র বাংলাদেশ' পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখা ছাপা হয়। তিনি একসময় দৈনিক "মাথাভাঙ্গা' (চুয়াডাঙ্গা) এবং দৈনিক গিরিদর্পণ (রাঙামাটি) পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। 'দৈনিক আমার কাগজ' পত্রিকায় তাঁর কবিতা দীর্ঘদিন প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ জলে জলে সমুদ্র ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়। একই বছর প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ অনাহারী অতিথি কাক (২০১২)। অতঃপর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ অন্তরে অন্তর টানে নিরন্তর (২০১৩) এবং প্রবন্ধের বই 'মা মাটি মানুষ ও সমকালীন প্রসঙ্গ' (২০১৩) প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৪ সালের বইমেলা উপলক্ষে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ হচ্ছে। ভ্রমণ কাহিনী-জাপান ভূমিকম্পের সঙ্গে সহাবস্থান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস ইতিহাস-একাত্তরের জীবন ও নির্বাসন, কবিতাগ্রন্থ হৃদয়ে হৃদয়ে যুদ্ধ এবং ছোটদের ছড়ার বই ইচ্ছেডানা। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে বিসিকের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ (একটি সমীক্ষা) নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ। ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় কবিতা- ভালোবাসার বেহুলা, শিশু- কিশোরদের জন্য সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের সতর্কতা এবং শরীয়তপুর জেলার সামগ্রিক বিষয়ে লেখা বই শরীয়তপুরের ইতিবৃত্ত। এছাড়া তিনি রাঙামাটি পার্বত্য জেলার উপর ২০০৪ সালে রাঙামাটি: বৈচিত্রের ঐক্যতান বইয়ের সহযোগি সম্পাদক ও লেখক ছিলেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন ও কর্মব্যস্ততার মাঝেও সাহিত্য চর্চার বিষয়ে শ্যামসুন্দর সিকদার তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছেন, “তবে আয় রোজগার করার জন্য আমি লিখি না। কোনো সম্মানীর জন্য আমি লিখি না। লেখালেখি আমার পেশা নয়, নেশা। আমার পেশাগত কাজের ক্ষতি করে আমি লেখার জন্য সময় ব্যয় করি না। আমি আপন আনন্দে মনের তাগিদে লিখি। আমি মনের শুদ্ধতার জন্য লিখি। এই হলো আমার লেখালেখির কারণ এবং অনুপ্রেরণা”। সাহিত্য রচনা ও গবেষণা কর্মের জন্য এ পর্যন্ত তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: নির্ণয় স্বর্ণপদক (২০১৩-১৪), সুফী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার (২০১৩-১৪), পদক্ষেপ পুরস্কার (২০১৫), বাউল তরী পদক (২০১৮), মুক্তিযুদ্ধের কবিতা সম্মাননা-২০১৮ ইত্যাদি।
শ্যামসুন্দর সিকদারের জন্ম শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার লোনসিং গ্রামে। তাঁর পিতা গিরেন্দ্র মোহন সিকদার ও মাতা কৃষ্ণদাসী সিকদার। তাঁর শিক্ষা জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কাটে ফেনীতে। ফেনী মডেল হাই স্কুলের শিক্ষার্থী হিসেবে ১৯৭৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি এবং ফেনী কলেজ থেকে ১৯৭৭ সালে এইচএসসি ও ১৯৭৯ সালে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৮ সালে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
এ লেখকের কর্মজীবন এর হয় শিক্ষকতা দিয়ে। এরপর ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। ওই বছরই বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৮৬ সালে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেন। তিনি মাঠ পর্যায়ে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সালে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করে প্রথমে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে তিনি বিসিকের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন। ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব হিসেবে বদলি করা হয়।