চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বরেন্দা একটি গ্রাম।যে গ্রামে রয়েছে সুতিহার দিঘি।দিঘিটি ঘিরে হিন্দু, মুসলমান ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ মিলেমিশে দিনবদলের চেষ্টা চালাচ্ছেন। বরেন্দা গ্রামটি নেজামপুর ইউনিয়নে।গ্রাম উন্নয়ন কমিটির মাধ্যমে গ্রামের লোকজনের দিন বদলাতে শুরু করেছে। তাঁদের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে এক সমিতি। এ সমিতির মাধ্যমে সুতিহার দিঘি ইজারা নিয়ে মাছ চাষ শুরু করা হয়। সে মাছ চাষের টাকা দিয়ে গ্রামের উন্নয়ন হচ্ছে।এ দিঘিতে মাছ চাষের আয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বরেন্দা গ্রামের লোকজন। এ দিঘিতে মাছ চাষের আয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বরেন্দা গ্রামের লোকজন। চারদিকে শুষ্ক জমি। এর মধ্যে টলটলে এক দিঘি। নাম সুতিহার। এই দিঘি শুধু পানির উৎস নয়, এটি সম্প্রীতির এক নিদর্শন। এ দিঘিতে মাছ চাষের আয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বরেন্দা গ্রামের লোকজন। দিঘিটি ঘিরে হিন্দু, মুসলমান ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ মিলেমিশে দিনবদলের চেষ্টা চালাচ্ছেন। বরেন্দা গ্রামটি নেজামপুর ইউনিয়নে। সম্প্রতি বরেন্দা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, দিঘির টলটলে জলে ভেসে বেড়াচ্ছে হাঁসের দল। সাঁতার কাটছে দুরন্ত বালকেরা। ঠিক শিল্পীর আঁকা ছবির মতো সুন্দর। দিঘির এক পাড়ে গাছের ছায়ার নিচে রয়েছে বাঁশের মাচা। সেখানে বসে ছিলেন আবদুল কাদের। তিনি বলেন, খরার দিনে (গরমের সময়) এখানে দুদন্ড বসে দেহ-মন জুড়ায় অনেকে। মেতে ওঠে খোশগল্পে। অন্যদিকে বরেন্দা মৎস্যচাষি সমবায় সমিতি লিমিটেডের কার্যালয় বাঁধানো সিঁড়িঘাটেও বসে চলছে আড্ডা।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রাম উন্নয়ন কমিটির মাধ্যমে গ্রামের লোকজনের দিন বদলাতে শুরু করেছেন। তাঁদের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে বরেন্দা মৎস্যচাষি সমবায় সমিতি লিমিটেড। এ সমিতির মাধ্যমে সুতিহার দিঘি ইজারা নিয়ে মাছ চাষ শুরু করা হয়। সে মাছ চাষের টাকা দিয়ে গ্রামের উন্নয়ন হচ্ছে।
গ্রাম উন্নয়ন কমিটির গোড়ার দিকের নেতা ও বরেন্দা লালজাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, এ দিঘি কবে খনন হয়েছে, তা কেউ বলতে পারেননি। তবে এটা বলা যায়, এ দিঘি শত বছরের পুরোনো। ভূমির সিএস রেকর্ডেও (১৯২২) এ দিঘির কথা উল্লেখ রয়েছে। আগে গ্রামের বাইরের প্রভাবশালী লোকজন ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করতেন। ১৯৭৫ সাল থেকে গ্রামবাসী যৌথভাবে ইজারা নিয়ে এ দিঘিতে মাছ চাষ করছেন। গোড়ার দিকে আয় খুব একটা বেশি হতো না। সেই আয় থেকে গ্রামের যৌথ অনুষ্ঠানের থালাবাসন, ডেকচি ও শামিয়ানা কেনা হয়। দৃশ্যমান উন্নয়ন শুরু হয় গ্রামের বিদ্যালয় নির্মাণের মধ্য দিয়েই।মাছ চাষের টাকা দিয়ে হয়েছে মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ ও শ্মশান।
মাছ চাষের টাকা দিয়ে হয়েছে মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ ও শ্মশান। আতাউর বলেন, একসময় গ্রামের শিশুদের দূরে লক্ষীপুরের বিদ্যালয়ে যেতে হতো পড়তে। তখন পথঘাট ছিল কাঁচা। বর্ষাকালে অনেক শিশুই পথঘাটের জন্য বিদ্যালয়ে যেত না। শিক্ষার হার ছিল খুবই কম। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুরা বিদ্যালয়ে যেত না বললেই চলে। অথচ গ্রামে লেখাপড়া করার মতো অনেক শিশু ছিল। তখন কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামেই একটি বিদ্যালয় স্থাপন করার। ১৯৮৭ সালে মাটির দেয়ালের চারটি ঘরের ওপর টিনের ছাউনি দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করেন তাঁরা। গ্রামের মানুষ এ জন্য জমি দান করেন, বাকি খরচ মাছ চাষের টাকায় মেটানো হয়। এখন বিদ্যালয়ের পাকা ভবন হয়েছে। সরকারীকরণ করা হয়েছে বিদ্যালয়টি। মাছ চাষের টাকা দিয়ে প্রায় ২৫ বছর আগে প্রতিটি পরিবারের জন্য বিনা মূল্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা ছিল তাঁদের ‘মাইলফলক’। এরপর একে একে হয়েছে মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ ও শ্মশান। হয়েছে সমিতির কার্যালয় ও দিঘির ঘাট। এ ছাড়া গ্রামের গরিব মানুষের অসুখে-বিসুখে, মেয়ের বিয়েতে ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে আর্থিক সহায়তা। করোনাকালে গ্রামের গরিব মানুষদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে প্রায় ১০০ মণ চাল।আতাউর বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা, এ দিঘি গ্রামের হিন্দু, মুসলমান ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সম্প্রীতির বন্ধনকে মজবুত করেছে। মিলেমিশে বাস করছি আমরা বহু বছর ধরে।
বর্তমানে বরেন্দা মৎস্যচাষি সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মোঃ আবদুল কাদের। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত দিঘির আয় থেকে গ্রামের উন্নয়নের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সরকারি নিয়ম মেনে দিঘি ইজারা পাওয়ার জন্য বরেন্দা মৎস্যচাষি সমবায় সমিতি লিমিটেড গঠন করা হয়েছিল। তবে গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সদস্যরাই সব সমন্বয় করেন। এ কমিটির সদস্যরা মৎস্যচাষি সমিতির মধ্যেও আছেন। বর্তমানে তিনি গ্রাম উন্নয়ন কমিটিরও সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।আবদুল কাদের বলেন, মসজিদের উন্নয়নে ১৫ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। ২৫ লাখ টাকা খরচ করে ৮ কাঠা জমির ওপর মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। কেনা হয়েছে শ্মশানের জন্য এক বিঘা জমি। ঈদগাহের জমি কিনে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে সমিতির কার্যালয়। চলছে মক্তব ভবনের কাজ।মৎস্যচাষি সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান বলেন, সবকিছু পরিচালিত হয় সমিতির সদস্যদের স্বেচ্ছাশ্রম ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে। মাছ ছাড়া ও ধরা হয় গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে। সে ব্যয়ও হয় আলোচনা করে সমঝোতার ভিত্তিতে। তিন বছর পরপর দুই সমিতির কমিটি গঠন করা হয় আলোচনা করে। এ নিয়ে কোনো বিভেদ হয়নি কোনো দিন। গ্রামের শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতির পরিবেশ নিয়ে তাঁরা গর্বিত। আর এই গর্বের উৎস সুতিহার দিঘি। সবাই ভালোবাসে এই দিঘিকে।
টুনু পাহান (৫৫) জাতীয় আদিবাসী পরিষদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। গ্রামের মৎস্যচাষি ও উন্নয়ন কমিটির দুটিতেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বলেন, বিপদে সাহায্য চেয়ে না পাওয়া কেউ নেই এ গ্রামে । প্রয়োজনের সময় না চাইলেও দেওয়া হয়। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে করোনাকালে সমিতির তহবিল থেকে এক লাখ টাকা খরচ করে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয় গ্রামবাসীকে। সিদ্ধান্ত হয় সব পরিবারকেই দেওয়া হবে। কিন্তু ২০টি সচ্ছল পরিবার তাদের চালগুলো দিয়ে দেয় অভাবী পরিবারগুলোকে। এরপর কিছু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারও তাদের চাল দিয়ে দেয় আরও অভাবী পরিবারের মধ্যে।রিকশাভ্যানে বাড়ি বাড়ি চাল পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে টুনু পাহানের সঙ্গে ছিলেন হাসান আলী। তিনি বলেন, ‘এমন গ্রামের বাসিন্দা হয়ে আমি গর্বিত। ভালোবাসি গ্রামবাসীকে, ভালোবাসি সুতিহার দিঘিকে।