গত ২৫ জুলাই হতে শুরু করে এ পর্যন্ত শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাঁকা গ্রামেই নদী গর্ভে বিলাীন হলো আড়াই‘শ টি পরিবারের বসতভিটা। বিলাীন হয়েছে ১৯৪৯সালে স্থাপিত দক্ষিণ পাঁকা নারায়নপুর পাবলিক উচ্চবিদ্যালয়,পাঁকা নারায়নপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। বসতবাড়ি হারিয়ে কেউ আশ্রয় নিয়েছে নিশিপাড়া চরের মধ্যে। যে এলাকাটি কয়েকবছর আগে নদী গর্ভে বিলীন হয়েছিল। কেউ বাস করছে খোলা আকাশের নীচে। আবার কেউ বা কোন আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।
সরেজমিনে কথা হয় কামাল হোসেনের সাথে। তিনি জানান, এ গ্রামের মানুষরা প্রায় ৫০বছরের ব্যবধানে ১০/১১বার পদ্মার ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। ১১বারই বাড়ি স্থানান্তর করতে হয়েছে। হারিয়েছে শেষ সম্বলটুকুও। তৈমুর রহমান জানান যদিও আমরা ১০/১১বার ভাঙ্গনের কবলে পড়েছি। তবুও মাত্র কয়েকজন ছাড়া সবাই সরকারী সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত আছি। পাঁকা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক জানান, পদ্মার ভাঙ্গনে বিশেষ করে দক্ষিণ পাঁকার মানুষ দিশেহারা হয়ে গেছে। তাদেও নেই কোন আশ্রয় স্থল, নেই কোন অন্ন, নেই পরনে কাপড়। যেন একেবারে নি:স্ব।
তিনি আরো জানান, গত এক মাসে দক্ষিণ পাঁকা গ্রামের আড়াই ‘শ টি বাড়ি, মসজিদ, মাদ্রাসা, গোরস্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আমবাগান, বাঁশ বাগান সহ প্রায় আড়াই শ‘ একর জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙ্গনের কবলে সারা জেলায় যা ক্ষতি হয়েছে তার মধ্যে শুধু দক্ষিণ পাাঁকাতে হয়েছে প্রায় তিন- চর্তুাংশ। জেলায় এ পর্যন্ত কোন সরকারী সাহায্য সহযোগিতা জনগণ পায়নি। তবে বগড়া কান্টনমেন্ট হতে আমার কাছে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর তালিকা চেয়েছে। এখনো তালিকা পাঠানো সম্ভব হয়নি। তবে আগামীকাল যাব তালিকা তৈরী করার কাজে। শুধু দক্ষিণ পাঁকাই নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর, চরবাগডাঙ্গা ও শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের অন্যান্য স্থানে ও-দূর্লভপুর ইউনিয়নে পদ্মা নদী আগ্রাসী রুপে পদ্মার তীব্র ভাঙনে দিশেহারা হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন মাত্র এক মাসের ব্যবধানে এ তিনটি ইউনিয়নে ব্যবধানে বিলীন হয়েছে দুটি স্কুল, তিনটি জামে মসজিদ, প্রায় সাড়ে ৩‘শ বসতবাড়ি ও ৩০ হাজার বিঘা ফসলি জমি। আরও হুমকির মুখে রয়েছে আমবাগান, সরকারি বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভাঙন কবলিত বাসিন্দরা জানায়, পদ্মার পানি কমলেও ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় গাছপালা, ফসলি জমি, গ্রাম, সড়ক, ঘরবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত তিন দশকে নারায়ণপুর, চরবাগডাঙ্গা ও পাঁকা-দূর্লভপুর ইউনিয়নে ভাঙনের কবলে পড়ে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে ৩০ হাজার বিঘা ফসলি জমি, বসতভিটা, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, মসজিদ ও কবরস্থান। বর্তমানে সদর উপজেলার নারায়ণপুর, চরবাগডাঙ্গা ও শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা-দুর্লভপুর ইউনিয়নের মনোহরপুরে পদ্মা নদীর ভাঙন চলছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে শিবগঞ্জের দুর্লভপুর ইউনিয়নের মনোহরপুর-রঘুনাথপুর থেকে শুরু করে নারায়ণপুর ইউনিয়নের জহুরপুর পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটারজুড়ে ভাঙ্গন চলছে। নারায়ণপুর আদর্শ মহাবিদ্যালয়সহ ১৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আশ্রয় কেন্দ্র, দুটি উচ্চ বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, সদ্য নির্মিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, সোলার প্লান্ট এবং স্থানীয় হাটবাজারসহ কয়েক শতাধিক একর ফসলি জমি। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত সদর উপজেলার নারায়ণপুর এলাকার বাদল রহমান জানান, ৩২ রশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছিলেন তারা। এখানে তাদের বাপ-দাদার জমিজমা ছিল। কিন্তু পদ্মার ভাঙনে সবকিছুই চলে গেছে। শিবগঞ্জ উপজেলার নামোজগন্নাথপুরের পন্ডিতপাড়ার কৃষক টিটু জানান, পদ্মা নদীর কোল ঘেঁষেই তার বসতভিটা। গ্রাম ছাড়া অন্য কোথাও গেলে যার মনে শান্তি মিলতো না। আজ সেই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। পন্ডিতপাড়া থেকে পাশের গ্রামে চলে যাবো। পরের জায়গায় ঠাঁই নিচ্ছি। ধারদেনা করে ফের ঘর তুলতে হবে।
একই গ্রামের মোহাম্মদ হানিফ বলেন, ১৯৪২ সালে আমার জন্ম। আগের বাড়ি ছিলো নদীর ওপারের গাঁ রঘুনাথপুরে।চারবার বাড়ি ভেঙেছি। এলাকায় মায়া বসলেও নিরাপত্তার তাগিদে ছাড়তে হয়েছে নিজের ভিটামাটি। বাপ দাদার থেকে পাওয়া জমিগুলোও নদীতে নেমে গেছে। নদী ভাঙনের তীব্রতা খুবই বেশি। কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরও বলেন, পদ্মা নদীতে ভাঙনের কারণে গতবার কিছুই টানার সুযোগ পাইনি। কয়েকটা টিনের চাল, বাক্স আর গোলায় ভরা ধান আনতে পেরেছিলাম। তাছাড়া সব নদীতে ভেসে গেছিলো। অল্প সময়েই নিঃস্ব হয়ে গেলাম। এলাকাবাসী জানান প্রায় আড়াই’শ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর ওপারের বাসিন্দাদের জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছিল সরকার। এটিও এখন হুমকির মুখে। আর হুমকির মুখে রয়েছে প্রায় ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ভাঙন আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ ব্যাপারে শিবগঞ্জ উপজলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার আরিফুল ইসলাম জানান, এ বছরে পদ্মার ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষের জন্য কোন কিছু বরাদ্দ হয়নি অ। পাাঁকা ওদূর্লবপুর ইউপি চেযারম্যানদ্বয়কে তালিকা তৈরীর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তালিকাা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। সদর উপজেলায়তে একই প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখার উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ময়েজ উদ্দিন জানান,সদর উপজেলার নারায়নপুর ও শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাঁকাসহ মোট ৬কিলোমিটার জুড়ে পদ্মার ভাঙ্গন চলছে। এ বছরর প্রায় ১‘শ মিটার ভিতরে ঢুকেছে। সদর উপজেলার নারায়নপুর ও শিবগঞ্জ উপজলোর পাঁকা ইউনিয়নে মোট জমির পরিমান ৪৬ হাজার বিঘা জমির মধ্যে ২৬ হাজার বিঘা পদ্মার ভাঙ্গণে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তার মধ্যে শুধু পাঁকার হবে প্রায় ৭০%।
তিনি জানান, এবছরে ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরির্দন করেছেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা :সামিল উদ্দিন আাহম্মেদ শিমুল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৩ আসনের সংসদ সদস্য ফেরদৌসি জোসি, জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খান, সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইফফাত জাহান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত)জুবায়ের হোসেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মিটুন মৈত্র, শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল হায়াত, উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পানি উন্নয়ন বোর্ডে,চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলী মুখলেশুর রহমান ও আমি( উপবিভাগীয় প্রকৌশলী) ময়েজ উদ্দিন আরো অনেকে।
তিনি আরো জানান, ভাঙ্গন কবলিত এলাকার জন্য স্থানীয় নিরাপত্তামুলক ব্যবস্থা গ্রহন করা সম্ভব নয়। তবে অস্থায়ী ভাবে জরুরী ভিত্তিতে জিও টিউবের মাধ্যমে প্রতিরক্ষামুলক ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য ২৫কোটি ব্যয়ের একটি প্রস্তাব পানি উন্নয়ন বোর্ডের কেন্দ্র অফিস ঢাকায় গত ২৯ আগষ্ট ২০২২খ্রী :তারিখে পাঠানো হয়েছে। পানি উন্নয়নের বোর্ঢের কেন্দ্রীয় অফিস সেটি অনুমোদন দিলে বরাদ্দ আসবে এবং জিও টিউবের মাধ্যমে ভাঙ্গন রোধের ব্যবস্তা গ্রগন করা হবে।