কাশেমগঞ্জ হাই স্কুলে ক্লাস সেভেনে (১৯৭৩) খালেক স্যার আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। স্যার বলতেন, মবে রাখবি, অতীতে যদি দুটি ঘটনা ঘটে থাকে তাইলে যেটি আগে ঘটেছিল সেটি হলো Past Perfect tense আর যেটি পরে ঘটেছিল সেটি Past Indefinite। যেমন, ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল-এর ইংরেজি হবে The patient had died before the doctor came. অথবা রোগী মারা যাওয়ার পর ডাক্তার আসিল হবে The doctor came after the patient had died. স্যারের এমন সহজ করে বলা আমাদের মনে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল। কাশেমগঞ্জ স্কুল ছেড়ে স্যার বরিশালে চলে গেলেন; স্কুল একজন মেধাবী শিক্ষককে হারালো।
বরিশাল ডিসি অফিসে শিক্ষা ও কল্যাণ শাখায় বসে কাজ করছি (১৯৯৬)। আধা-পাকা দাড়িওয়ালা একজন সফেদ মানুষ দরজায় পর্দা গলিয়ে মুখটি বের করে অনুমতি চাইলেন, ভিতরে আসতে পারি? প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও চিনতে পারি আমার সেই খালেক স্যার দরজায় দাঁড়িয়ে! দ্রুত উঠে স্যারকে কদমবুচি করলে স্যার জড়িয়ে ধরলেন, দেখতে পেলাম আমার সাথে স্যারের চোখেও পানি।

স্যার বল্লেন, সুলতান, তোমার কাছে এসেছি, তুমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, আমার কাজটি একটু করে দিতে হবে। আমি মথুরানাথ পাবলিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক, স্কুলে অনেক ছাত্র, ক্লাসরুমের অভাব; ওয়েজ আর্নারস কল্যাণ তহবিল থেকে চার লাখ টাকা পেয়েছি, স্কুল থেকে আরও চার লাখ দিতে কমিটি রাজী হয়েছে, তুমি আমাদের একটি ভবন করে দাও।
মথুরানাথ পাবলিক স্কুল কমিটিসহ স্কুল ক্যাম্পাসে গিয়ে নতুন ভবনের স্থান ঠিক করে সিদ্ধান্ত হলো ১০০ ফুট লম্বা ৩০ ফুট চওড়া চার রুমের (প্রতি রুম ২৫ ফুট বাই ২৪ ফুট, ৬ ফুট টানা বারান্দা, ফাউন্ডেশন তিন তলার) একটি ভবন নির্মাণ করা হবে। ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্টের স্কুলভবন নির্মাণ ও স্কুল ফার্নিচার কোয়ালিটি তদারকির কমিটিতে জেলা প্রশাসকের পক্ষে আগে থেকেই কাজ করার সুবাদে তাদের তিন রুমের স্কুল ভবনের (৭৫ ফুট বাই ৩০ ফুট) নকশা এবং স্পেসিফিকেশন আমার কাছে ছিল, সেটির ফাউন্ডেশন একটু বড় করে নিয়েছি আর একটি রুম বাড়িয়েছি। স্যারসহ স্কুল কমিটির কয়েকজন নিয়ে ইটের ভাটায় গিয়ে ইটের চুক্তি করে ফেল্লাম; রড-সিমেন্টের দোকানে গিয়ে চুক্তি করে ফেল্লাম। ৮০% টাকা অগ্রিম দিয়ে ইটভাটা আর দোকানের মালিকদের সাথে পাকাপাকি কথা বল্লাম, যখন প্রয়োজন হবে তখন জানালে তারা মাল স্কুলের মাঠে পৌঁছে দিবেন। বলাবাহুল্য, ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার সুবাদে কাজ অনেক সহজ হয়েছিল। ফার্স্টক্লাস ব্রিক, তাজা সিমেন্ট আর বিলেট রড পেতে অসুবিধা হয়নি। রাজমিস্ত্রী নিয়োগ করে কাজ শুরু করে দিলাম। অফিস শেষে আর শুক্র-শনি পড়ে থেকেছি মথুরানাথ পাবলিক স্কুল ক্যাম্পাসে। তদারকির কাজে স্কুল ক্যাম্পাসে গেলে খালেক স্যার নতুন বাজারের বিখ্যাত নিতাইর রসগোল্লা আনাতেন। স্যারের দিকে তাকালে স্যার বলতেন, সুলতান খাও, তোমাকে তো স্কুল ফান্ডের টাকা দিয়ে আপ্যায়ন করতে পারি না, এটি তোমার স্যারের পক্ষ হতে। নিবিড় তদারকিতে ধীরে ধীরে ভবন উঠতে শুরু করলো, একদিন ১০০ ফুট বাই ৩০ ফুটের ভবন চোখের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। হিসাব কষে দেখলাম স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী রড-সিমেন্ট-বালু আর ফার্স্টক্লাস ব্রিক দিয়ে কাজ করেও ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্টর এস্টিমেটের চেয়ে ৫৩% খরচে ভবনটি নির্মাণ করতে পেরেছি।

খালেক স্যার আর আমাদের মাঝে নেই। আল্লাহ স্যারকে জান্নাতবাসী করুন।
এবার কোরবানীর ঈদের আগে বরিশাল গিয়ে মথুরানাথ পাবলিক স্কুলে গিয়ে কিছুক্ষণ ছিলাম, স্কুলের কিছু ছবি তুলেছিলাম।
লেখক: বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব