দীর্ঘ এক মাস পর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। সোমবার সন্ধ্যা ছয়টার কিছুক্ষণ আগে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন তারা। সেখানে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী দুই নেতাকে ফুলের মালা দিয়ে অভিনন্দন জানান। তারা মুহুর্মুহু স্লোগানে দুই নেতাকে বরণ করে নেন। এসময় সেখানে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন মির্জা ফখরুল।
কারাগার থেকে বেরিয়ে নেতা–কর্মীদের ধন্যবাদ জানান বিএনপির জ্যেষ্ঠ দুই নেতা। এ সময় ছাদখোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ গ্রেপ্তার দলীয় নেতা-কর্মীদের মুক্তি দিতে হবে। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, অত্যাচার, নির্যাতন, জুলুম করে আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা যাবে না। আমি বিশ্বাস করি, জনগণের অংশগ্রহণে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে এবং সরকারের পতন ঘটবে।
কারাগারে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, এরা চোর নয়, ডাকাত নয়। কারাগারে আমাদের নেতা-কর্মীরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এঁরা রাজবন্দী। এঁদের সঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষের ভালো ও মানবিক আচরণ করতে হবে।
রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে ‘অবৈধ’ সরকারের পতন ঘটাতে হবে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য। সরকার পতনের আন্দোলনে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এ সময় বিএনপির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মনিরুল হক চৌধুরী, বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম, মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন, কেন্দ্রীয় শ্রমিক দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, বিএনপির সহশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক মীর নেওয়াজ আলী, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আইনজীবী জাকির হোসেন ও মির্জা আব্বাসের আইনজীবী মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সেখান থেকে কারামুক্ত বিএনপি নেতারা সরাসরি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসেন। কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের পিছু হটার কোনো পথ নেই। আমাদের পথ শুধু সামনে এগিয়ে চলা।
তিনি বলেন, ইনশা আল্লাহ গ্রেপ্তার করে, কষ্ট দিয়ে, নির্যাতন করে আমাদের দমন করতে পারবে না। এ দেশের মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য জেগে উঠেছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এই স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারকে পরাজিত করব। যত বেশি অত্যাচার করবে, নির্যাতন করবে, তত বেশি মানুষ ফুঁসে উঠবে।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, তারা ভেবেছিল বিএনপির অফিস আক্রমণ করে, একেবারে দিনদুপুরে ডাকাতের মতো হামলা করে, নেতা-কর্মীদের হত্যা করে এ আন্দোলনকে বন্ধ করে দেবে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে বন্ধ করে দিতে পারবে। কিন্তু পারেনি। এটা আরও শক্তিশালী হয়েছে। ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ, এরপর গণমিছিলে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ঢাকা শহর সয়লাব হয়ে গেছে। আজ গোটা বাংলাদেশ প্রতিবাদের ঝড়ে প্রকম্পিত হয়েছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, আমরা মাত্র দুজন বেরিয়েছি। আরও হাজারো নেতা-কর্মী কারাবন্দী রয়েছেন এবং তাঁরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এই সরকার সারা দেশকে একটি কারাগারে পরিণত করেছে।
এসময় কারামুক্ত মির্জা আব্বাস বলেন, এ দেশের মাটি ও মানুষকে রক্ষা করতে হবে, মানুষের ভোটের অধিকারকে রক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা জেলে গেলাম কেন? মির্জা ফখরুল ইসলামের অপরাধ কী, আমার জানা নেই। তবে আমার অপরাধটা আমার জানা আছে। ১০ তারিখের মিটিংয়ে (১০ ডিসেম্বর ঢাকার গণসমাবেশ) সরকার চেয়েছিল আমরা জোর করে হলেও পল্টনে করি। তাহলে মারামারি করে বিএনপিকে দোষারোপ করত। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম সংঘাত নয়, শান্তিপূর্ণভাবে করতে। পুলিশও রাজি হলো। আমি রাত ১২টা পর্যন্ত মিরপুর, কালশী, গোলাপবাগ ঘুরে বাসায় গেলাম, তখন আমাকে গ্রেপ্তার করে; অর্থাৎ সরকারকে সর্বশেষ সুযোগটিও দিলাম না, এটাই আমার অপরাধ।
এ সময় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক নবী উল্লাহ, দলের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ, ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্যসচিব আমিনুল হক, দক্ষিণের সদস্যসচিব রফিকুল আলম, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোনায়েমসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ সামনে রেখে গত ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পরদিন গভীর রাতে দলের শীর্ষস্থানীয় এই দুই নেতাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে তাদেরকে ৭ ডিসেম্বরের সংঘর্ষের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসের জামিন আবেদন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে তিনবার নাকচ হয়। পরে তাদের জামিনের জন্য উচ্চ আদালতে যান আইনজীবীরা। গত মঙ্গলবার হাইকোর্ট রুলসহ দুজনের ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এই আদেশ স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন রোববার আপিল বিভাগে শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ এদিন বিএনপির এই দুই নেতার ছয় মাসের জামিন আদেশ বহাল রাখেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসের জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন এ খবর রোববারই নেতা–কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সোমবার তাদের স্বাগত জানাতে কারাগারের সামনে জড়ো হয়েছিলেন বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মী। মুক্তির পর কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে মির্জা ফখরুল ও আব্বাসকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন অপেক্ষারত নেতা-কর্মীরা। এ সময় বিএনপির নেতা-কর্মীরা খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।