দীর্ঘ চার বছর অপেক্ষার পর ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হচ্ছে আজ। মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবের দেশ কাতারে বসতে যাচ্ছে ফুটবলের এই বড় আয়োজন। ১৯৩০ সাল থেকে ২০১৮- গত ৯০ বছরে অনুষ্ঠিত হয়েছে ২১টি আসর। আফ্রিকা, ইউরোপ মহাদেশে ঘুরে ২০ বছর পর এশিয়ায় ফিরেছে ‘গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ’। আল বায়েত স্টেডিয়ামে আজ রাত ১০টায় স্বাগতিক কাতার-ইকুয়েডর ম্যাচ দিয়ে মাঠে গড়াবে বিশ্বকাপ। এর আগে বাংলাদেশ সময় রাত আটটায় শুরু হবে ৪৫ মিনিটের উদ্বোধনী পর্ব, যেখানে এক সঙ্গে ৬০ হাজার দর্শক বসতে পারবেন।
ফুটবলঈশ্বর ম্যারাডোনাকে ছাড়া প্রথম বিশ্বকাপ। যেখানে সবার চোখ থাকবে লিওনেল মেসির দিকে। এটি যে তার খেলোয়াড়ীজীবনের শেষ বিশ্বকাপ। ২৮ বছরের আক্ষেপ ঘুচিয়ে গেল বছর আর্জেন্টিনাকে এনে দিয়েছেন কোপা আমেরিকা। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলেও জার্মানির কাছে অতিরিক্ত সময়ের গোলে ট্রফি ছোঁয়া হয়নি গ্রহের সেরা ফুটবলারের। এটি পর্তুগিজ তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোরও শেষ বিশ্বকাপ; বিদায় নিতে পারেন ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমারও। আবার কিলিয়ান এমবাপের জন্য নিজেকে আরও উঁচুতে নেওয়ার মঞ্চ। যেখানে উঠে আসতে পারেন অনেক নতুন তারকা।
কাতারকে বিশ্বকাপের স্বত্ত্ব দেওয়ার সমর্থন ছিল না ইউরোপের দেশগুলোর, ফুটবল সংস্কৃতির দেশ নয় কাতার। আবহাওয়া অনুকূলে নয়। ‘ঘুষ দিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজন, সূচি পরিবর্তন, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে আয়োজক দেশটির বিরুদ্ধে। বিশ্বকাপ যখন দুয়ারে তখনও সে অভিযোগ আছে। ইউরোপের বেশ কিছু দেশ বিশ্বকাপের মুখে এসেও প্রতিবাদ করেছে। জার্মানির বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক ফিলিপ লাম বিশ্বকাপ বয়কট করেছেন। ডেনমার্ক প্রতিবাদ করেছে। তারা শ্রমিক মৃত্যু ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ করে বিশেষ জার্সি পরতে চেয়েছিল।
২১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের বিশ্বকাপ মাঠে গড়ানোর ঠিক আগের দিন স্বাগতিকদের বিপক্ষে নতুন অভিযোগ উঠেছে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের! ব্রিটিশ মিডল ইস্ট সেন্টার ফর স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চের বাহরাইনভিত্তিক আঞ্চলিক পরিচালক আমজাদ তাহা টুইটে জানান, ‘উদ্বোধনী ম্যাচ জিততে ইকুয়েডরের খেলোয়াড়দের ৭.৪ মিলিয়ন ঘুষ দিয়েছে কাতারিরা, ৯০ মিনিট শেষে ফল হবে ১-০। কাতার ও ইকুয়েডরের পাঁচ ফুটবলার নাকি খবরের সত্যতাও যাচাই করেছে। সেটা রং চড়িয়েছে স্পেনের ক্রীড়াবিষয়ক গণমাধ্যম মার্কা। অবশ্য এ নিয়ে এখনও কাতার কোনো বক্তব্য দেয়নি। কারণ ফিফার মতো তাদেরও ভাবনা জুড়ে বিশ্বকাপটা ভালোয় ভালোয় শেষ করা।
বিশ্বকাপ গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেরও ফুটবলের মাস, যে মাস ঘিরে বাঙ্গালি ফুটবলপ্রেমীদের কতশত পরিকল্পনা। দিন যত ঘনায়, আমোদ-উন্মাদনা বাড়তে থাকে। এ যেন ভাইরাস জ্বর। যে জ্বরে কাঁপে গোটা জাতি, জ্বরের তীব্রতা কতটুকু হতে পারে? যুবকের দল বিশ্বকাপ শুরুর আগে বাড়ির ছাদে, গাছে, গ্রামের রাস্তায়, গাড়িতে- যেখানে সেখানে প্রিয় দলের পতাকা টানিয়ে আনন্দ উপভোগ করছে। কে কত বড়, বা কত বেশি সংখ্যক বেশি পতাকা কিংবা ব্যানার টানাতে পারল তা নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। পাড়া-মহল্লায়, শহর বন্দরে- দোকানে আর প্রতিষ্ঠানে প্রিয় দলের পতাকা টানানো এই দেশে স্বাভাবিক ব্যাপার। যেদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান থানাতেও আর্জেন্টিনা- ব্রাজিলের সমর্থনে পতাকা/ব্যানার দেখা যায়; প্রধানমন্ত্রীর- রাষ্ট্রপতিরও যে একটা সমর্থিত বিশেষ দল আছে তা জাতি জুড়ে জানাজানিও হয়। বিশ্বকাপ এলেই তারকাদের প্রিয় দল কোনটি, জানতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মিডিয়া। সবাই সামিল হয় এই মিছিলে।
কাতার বিশ্বকাপের থিম সং ‘বেটার টুগেদার’এ বিশ্বকাপের ঝাঁজ খুব একটা পাওয়া যায় না। কিন্তু ঐক্যের ডাক পাওয়া যাবে, যা এখন অশান্ত দুনিয়ায় শান্তির বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। হিপ হপ গায়ক ত্রিনিদাদ কারডোনার লিখা ও গাওয়া গানের কয়েকটা লাইন এমন, ‘জীবনে ওঠা-নামা থাকবে তাতে আমাদের কি করার আছে?/আমরা রুক্ষ ও কঠিন পথকে মসৃণ করে সাজিয়েছি/আমরা আনন্দ, উৎসবের ছন্দ খুঁজে পেয়েছি/কখনো দুঃখের নীল সাজবো না যখন আমরা একসঙ্গে থাকি/আপনি জানেন আমরা একসঙ্গে ভালো থাকি/আর অপেক্ষায় রাখতে চাই না/আপনি জানেন আমরা একসঙ্গে থাকি/সেই সময়টা আজই এবং এখনই।’
রাশিয়া বিশ্বকাপের পর্দা নামার পর গত চার বছরে যে প্রশ্নটা ফুটবল বিশ্ব সবচেয়ে বেশিবার করেছে, কাতার কি সত্যি বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারবে? মরুর দেশে বিশ্বকাপ। ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেবার কাতারকে বেছে নেয় তখন থেকে ইউরোপিয়ান দেশগুলো কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে রীতিমত নাক সিটকানো শুরু করে। প্রথমত, কাতারের গরম। দ্বিতীয়ত, ইউরোপিয়ান সংস্কৃতির চর্চা। কিন্তু সব জল্পনা কল্পনা শেষ করে কাতার প্রথম দেশ হিসেবে উপদ্বীপে এককভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে। বছরখানেক আগে লিভারপুলের ম্যানেজার ইয়ের্গুন ক্লপ বলেছিলেন, ‘এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আয়োজন, এবং যা দরজায় কড়া নাড়ছে। ১২ বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছে, কি হবে না হবে। কিন্তু কেউই দীর্ঘ সময় ধরে চিন্তা করেনি। এখন যখন বিশ্বকাপ শুরুর অপেক্ষায় তখন কেউ তা পরিবর্তন করতে পারবে না।’
মূলত কাতারের গরম নিয়েই যত আলোচনা। তপ্ত মরুর বুকে উত্তপ্ত ফুটবল কতটা জমিয়ে তুলবে, তা নিয়ে আলোচনা থেমে নেই। মেসি, নেইমার, রোনালদো, এমবাপ্পেদের পায়ের জাদুতে বুঁদ হবে বিশ্ব। কিন্তু কন্ডিশনই যেন সব বাধা। তবে উৎসব কি থেমে আছে? সার্জিও অ্যাগুয়েরো গতকাল কাতার পৌঁছেছেন। যে বিমানে উঠেছিলেন সেখানে ব্রাজিল সমর্থকরা রীতিমত উৎসব করেছে। এটা তো শুধু একটি উদাহরণ। গত এক সপ্তাহে কাতারে পৌঁছেছেন বিশ লাখেরও বেশি সমর্থক। ৩২ দেশের সমর্থকরা প্রিয় দলের খেলা মাঠে বসে বা মাঠের বাইরে বড় পর্দায় বসে উপভোগ করবেন তাদের আনন্দ।
কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন সেপ ব্ল্যাটার। ফিফার সাবেক প্রেসিডেন্ট নিজের এই সিদ্ধান্তে অনুতপ্ত তা কিছুদিন আগেই বলেছেন এভাবে, ‘আমার কাছে সব কিছু পরিস্কার, কাতারকে পছন্দ করা ভুল হয়েছে। খুব বাজে সিদ্ধান্ত। কাতার ছোট দেশ। ফুটবল ও বিশ্বকাপ বড় দেশের জন্য।’ এক যুগ আগে মরুর দেশকে বেছে নিয়ে ব্ল্যাটার অসম্ভবকে সম্ভব করার কথা বলেছিলেন, কাতার করে দেখিয়েছেও। নান্দন্দিক স্টেডিয়াম, উচ্চাভিলাষী, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে ঠিকই, কিন্তু নিজেদের কড়া ধর্মীয় অনুশাসন, সংস্কৃতি ও সামাজিকতার বেড়াজালে ফুটবলপ্রেমিদের আনন্দে, পাগলামিতে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে আয়োজকরা। কি করা যাবে কি করা যাবে না মুখস্থই থাকতে হবে সমর্থকদের। নয়তো কড়া শাসন কায়েম করাও হবে।
বিশ্বকাপে সমকামিতা নিষিদ্ধ করায় রেইনে বো আর্মব্যন্ড পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ওয়েলস, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ডের মতো ইউরোপের দেশ। এর মধ্যে কাতার বিশ্বকাপের সমর্থন করতে গিয়ে ফিফা প্রেসিডেন্ট জিওন্নি ইনফান্তিনো যেমন কিছু তিক্ত সত্য বলেছেন তেমনি অদ্ভূত মন্তব্যও করেছেন।