তত্তাবধায়ক সরকার ছাড়া এদেশে কোন নির্বাচন হবে না বলে ফের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এদেশের মানুষের মনের দাবি। কারণ গত দুটি নির্বাচনে মানুষের সঙ্গে প্রবঞ্চনা-প্রতারণা করে, মানুষকে ভুল বুঝিয়ে নির্বাচন নির্বাচন খেলা করে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু এবার সে সুযোগ হবে না। মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এবার নিরপেক্ষ সরকার না দেয়া পর্যন্ত এদেশে কোন নির্বাচন হবে না।
আমাদের স্পষ্ট কথা। আমরা চাই এই মুহুর্তে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ। পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ বিলুপ্ত করে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন গঠন করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
গতকাল শনিবার ফরিদপুরে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন মির্জা ফখরুল। পরিবহণ ধর্মঘটসহ নানা বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে বিকালে ফরিদপুর শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে কোমরপুরের আব্দুল আজিজ ইনস্টিটিউট মাঠে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
জ্বালানী ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, নেতাকর্মীদের হত্যা ও নির্যাতন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে ঘোষিত বিভাগীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে শনিবার ফরিদপুরে এই গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ সমাবেশকে ঘিরে শুক্রবার থেকে ফরিদপুরে শুরু হয় বাস ও মিনিবাস ধর্মঘট। এতে ফরিদপুরের সঙ্গে সারাদেশের পরিবহন যোগাযোগ বন্ধ ছিল। বাস চলাচল বন্ধ থাকায় নেতাকর্মীরা পায়ে হেঁটে, নসিমন, ইজিবাইকে, মোটরসাইকেলে বা ভিন্ন উপায়ে সমাবেশস্থলে পৌঁছান। এমনকি অনেকে দুইদিন আগে থেকেই সমাবেশ স্থলে অবস্থান নেন।
দুপুর ১২টার দিকে ফরিদপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এ এফ এম কাইয়ুম জঙ্গির সভাপতিত্বে এ গণসমাবেশ শুরু হয়।
দুপুর ১২টার দিকে ফরিদপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এ এফ এম কাইয়ুম জঙ্গির সভাপতিত্বে এ গণসমাবেশ শুরু হয়। তবে সকাল থেকেই সমাবেশ স্থল নেতাকর্মীতে ভরে যায়।
এ সমাবেশে নানা বাধার ঘটনায় আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সমাবেশে যেতে পুলিশ বাধা দেয়। আওয়ামী লীগ নাকি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে! ভূতের মুখে রাম নাম। তাদের গণতন্ত্র মানে গুম, খুন, মামলা, হামলা করা। তাদের এত ভয় কেন?
তিনি বলেন, ক্যাসিনো সম্রাট মুক্তি পান আর খালেদা জিয়াকে আটকে রাখা হয়। তারেক রহমানকে সাজিয়ে-গুছিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে রেখেছেন। দেশে আসতে দেওয়া হয় না। যে সাজা দেয়া হয়েছে তা টিকবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বর্তমান সরকারের আমলে গত এক যুগে ১০ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, দেশের সম্পদ লুট করে তারা বিদেশে পাচার করছে। সরকার কোথায় চুরি করেনি? মেগা প্রজেক্ট থেকে শুরু করে বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা পর্যন্ত চুরি করেছে।
তিনি বলেন, বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
বিকেল ৪টা ২৮ মিনিটে শুরু করে প্রায় আধা ঘণ্টা বক্তব্য দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা এই বাংলাদেশ চাইনি। আমরা চাইনি আমাদের ছেলেরা পড়াশোনা শেষ করে হকারি করবে, মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করবে, ভালো চাকরির ব্যবস্থা তাদের হবে না। তিনি আরও বলেন, দেশের ৪২ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বলা হয়েছিল, ১০ টাকা সের চাল খাওয়ানো হবে, ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়া হবে, বিনা মূল্যে সার দেওয়া হবে, তার কিছুই হয়নি।
মির্জা ফখরুল বলেন, ফরিদপুরে অনেক দেশপ্রেমিক মানুষের জন্ম হয়েছে। তারা মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করেছেন। একইভাবে অধিকার আদায়ের জন্য নানা বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে মানুষ গত তিন দিন ধরে এই সমাবেশস্থলে অবস্থান নিয়ে আছেন। এজন্য সবাইকে স্যালুট জানিয়ে তিনি বলেন, এবার ভোটের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নেমেছে মানুষ। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কেউ ঘরে ফিরে যাবে না।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, এবার সময় এসেছে নতুন করে যুদ্ধ করার। আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা আর ওদের হাতে শৃঙ্খলের জিঞ্জির। তারা মনে করেন এদেশ তাদের। এদেশ তাদের বাপের দেশ। গুম, খুন করে রেহাই পাবেন না। আজ আপনারা গণতন্ত্রের কথা বলেন, গণতন্ত্র আপনারা শেষ করে দিয়েছেন। তাদের ভাবটা এমন তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই। কিন্তু এবার আর তা হবে না। মানুষ জেগে উঠেছে। এবার আর রাতের ভোট হবে না।
ক্রসফায়ারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আবার ক্রসফায়ার শুরু করেছেন। তারা (সরকার) মনে করেন আমরা কেউ না। আমরা চাকর-বাকর। আমরা রুখে দাঁড়াবো। দেশনেত্রীকে মুক্ত করবো। আমাদের এক দফা এক দাবি, ফয়সালা হবে রাজপথে। টেক ব্যাক বাংলাদেশ।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অচিরেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হবে। অতীতে যেমন কোনও স্বৈরাচার সরকারই দমন-পীড়ন চালিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারেনি, বর্তমান ক্ষমতাসীনরাও গায়ের জোরে ক্ষমতা রাখতে পারবে না। পতন তাদের হবেই।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ফরিদপুরের সমাবেশ পণ্ড করতে তিন দিন আগে থেকেই বাস মালিক শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। তাতে কী হয়েছে? জনগণকে তো সমাবেশে আসা আটকাতে পারেনি। তারা সমাবেশে ছুটে এসেছে। পথে পথে সিকিউরিটি বসিয়েছে, তবুও বাংলার মানুষ বাধা উপেক্ষা করে চলে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, দেশে-বিদেশে যখন আওয়ামী সরকারের বর্বর শাসনের বিরুদ্ধে ধিক্কার উঠেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের যখন নাভিশ্বাস অবস্থা, তখন সরকার হতাশ হয়ে পড়েছে। তারা এখন পাগল হয়ে গেছে। আপনারা ফরিদপুরের মানুষ আজ দেখিয়ে দিয়েছেন। ফরিদপুরের মাটি বিএনপির ঘাঁটি। ২০১৪ সালে যে নির্বাচন হয়েছিলো তাতে কি আপনার ভোট দিতে পেরেছেন? ২০১৮ সালে আরেকটা নির্বাচন হয়েছে, সেটাতেও আপনারা ভোট দিতে পারেননি, কারণ আগের দিন রাতেই তারা সিল মেরে নিয়েছে। এভাবে চললে হবে না। আজকের তরুণ সমাজ ইস্পাতের মতো রুখে দাঁড়াতে হবে।
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, গণসমাবেশের প্রধান সমন্বয়কারী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহিরুল হক শাহজাদা মিয়া, গণসমাবেশের সমন্বয়কারী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, দুই সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাশুকুর রহমান ও মো. সেলিমুজ্জামান প্রমুখ।