সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে সংলাপ শুরু করেছে বিএনপি। মঙ্গলবার বিকালে নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে এই সংলাপ কার্যক্রম শুরু করে দলটি। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য দলের সঙ্গে আলোচনা শেষে অতি দ্রুত একক দাবিনামা তৈরি করে সেই প্রেক্ষিতে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কর্মসুচি প্রস্তুত ও আন্দোলন শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে রাজধানীর সেগুনবাগিচার তোপখানা রোডের নাগরিক ঐক্যের কার্যালয় সংলগ্ন শিশুকল্যাণ পরিষদের সম্মেলন কক্ষে এ বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে অংশ নেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম ও দলটির সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন। আর নাগরিক ঐক্যের পক্ষ থেকে বৈঠকে অংশ নেন দলটির সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সারসহ ১০-১৫ জন নেতা।
এর আগে বেলা ৫টার দিকে মির্জা ফখরুলের নেতৃত্ব বিএনপির প্রতিনিধি দল নাগরিক ঐক্যের কার্যালয়ে আসলে মাহমুদুর রহমান মান্না তাদের স্বাগত জানান।
প্রায় দেড় ঘন্টাব্যাপী বৈঠক শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আজকের বৈঠক আনুষ্ঠানিক হলেও কোন সাড়ম্বরপূর্ণ ছিল না। আন্দোলন নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছি। এখন আন্দোলনের একটা পর্যায়ে চলে এসেছি। আমরা বিজয় পর্যন্ত লড়াই করব। এই চিন্তার ভিত্তিতে কাজ করছিলাম। আজকের বৈঠকের প্রথমেই আমরা সেই কথার পূনর্ব্যক্ত করেছি। এবং এটাই আমাদের ভিত্তি ছিল। এরপর এই আন্দোলনকে যৌক্তিক পর্যায়ে কীভাবে নিয়ে যাওয়া যায়, আমাদের দলগুলোর পারস্পারিক বোঝাপড়া-সমঝোতা, আমাদের নিজেদের দলগুলোর সমস্যা, রাজনৈতিক সংকট নিয়েও কথাবার্তা বলেছি। যেমন বিএনপির পক্ষ থেকে একটা কথা বলা হয়েছে, আমরা আগেও ভেবেছি এবং এখনও গভীরভাবে উপলব্ধি করি যে, এই সরকারের আমলে বিএনপির ওপর নিগ্রহ যত বেশি হয়েছে, আমাদের ওপর তত হয়নি। ওনারা এগুলোর একটা ব্যাখ্যা বলেছেন। আমরা তাদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে লাখ লাখ মামলা, দÐিত কিংবা এখনও দÐ পাননি, বিচারাধীন অনেকে আছেন। তাদের দলের মূল নেত্রী চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনের নাম করে একধরণের ফাজলামি করে তাকে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। এসব অসুবিধার কথা বলেছেন, সেগুলোকে আমরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছি। আমরা এই আন্দোলনটাকে গড়ে তুলব। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, তারা সবার সাথে কথা বলা শুরু করেছেন। আজকেই তাদের প্রথম দিন ছিল। তারা সবার সঙ্গে কথা বলবেন। যত কম সময়ে কথা বলা শেষ করা যায়। তারপর তারা আবারও এটাকে পরবর্তী ধাপে নেওয়ার জন্য সবার সাথে কথা বলবেন। এরমধ্যে নিজেদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা চলবে। একটি বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে আজকের এই বৈঠককে আমরা বিবেচনা করছি। বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বিএনপির ভূমিকাই বড় হবে।
এসময় সংলাপের বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মাহমুদুর রহমান মান্না সংক্ষিপ্তভাবে যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন-এটাই ছিল আজকের বৈঠকের মূল বিষয়বস্তু। আমি আগেই বলেছি, আমরা গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার, মানুষের হারিয়ে যাওয়া অধিকারগুলোকে, বিশেষ করে তাদের ভোটের অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার, তাদের ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার, তাদের কল্যাণের অধিকারগুলোকে ফিরে পাওয়ার জন্য, আজকের ফ্যাসিস্ট সরকার যারা এসব অধিকারকে হরন করেছে, তাদেরকে সরিয়ে সত্যিকার অর্থে জনগণের একটি সরকার-পার্লামেন্ট গঠন করার জন্য আমরা বৃহত্তর আন্দোলনের কথা ভেবে এবং এরইমধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ করে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছি, এটাকে একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আজকে দেশের মানুষ আশা করে আছে যে, বিরোধীদলগুলো একটি ঐক্যের মাধ্যমে এ সরকারের বিরুদ্ধে একটি সফল কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলবে এবং সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন হবে। এবং সেই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জনগণের একটি সরকার-পার্লামেন্ট গঠন হবে। সেই লক্ষে আমরা কথা বলেছি। আমরা এখনও কথা বলছি, অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে কথা বলব এবং অতিদ্রæত আলাপ-আলোচনা শেষ করে আমরা আশা করছি, যৌথভাবে একটা আন্দোলনের সূচনা করতে পারব।
আমাদের কথা বলার প্রধান বিষয়টি হচ্ছে-গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, অন্যতম প্রধান বিষয় হচ্ছে-একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। নির্বাচন কমিশন পরিবর্তন এবং পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যে নির্বাচন হবে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দলকে নিয়ে মতামতের ভিত্তিতে একটি সরকার গঠন করা, যেটাকে আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, একটা জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। এগুলোই ছিল আলোচনার মুখ্য বিষয়। আরেকটি প্রধান বিষয় আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, আমাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে আটক করে রাখা হয়েছে তার মুক্তি, বিরোধীদলগুলোর মিথ্যা মামলা-গায়েবি মামলায় যাদের আটক রাখা হয়েছে তাদের মুক্তি এবং মামলা প্রত্যাহার এবং চলমান নিপীড়ন বন্ধ করা। আজকের আলোচনা অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এবং কার্যকরী একটা আলোচনা হয়েছে। বাকি দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা ফলপ্রসু হবে বলে আশা করছি এবং অতি দ্রæত সত্যিকার অর্থে একটা আন্দোলনের কর্মসুচি নিয়ে প্রস্তুত হতে পারব।
এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংলাপ শুরু করার বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিস্তারিত জানান তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, স্থায়ী কমিটির সভায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মঙ্গলবার এই আলোচনা আমরা শুরু করব। আমরা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলব। তাদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা চূড়ান্ত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের যে রূপরেখা, সেই রূপরেখা তৈরি করা হবে।