পবিত্র হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা হবে আজ শুক্রবার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এবারের হজে অংশগ্রহণকারী ১০ লাখ মুসলিম আজ সৌদি আরবের ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দানে সমবেত হবেন। হজ পালনকারীদের মুখে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়াননি'মাতা লাকা ওয়ালমুলক’ ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠবে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিদায় হজের স্মৃতিবিজড়িত এই স্থান। সেখানে মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা দেবেন নির্ধারিত খতিব। একসঙ্গে জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করবেন হাজীরা। দিনভর অবস্থান শেষে সন্ধ্যায় আরাফাত ময়দান থেকে মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন সবাই। করোনা মহামারির কারণে দুই বছর পর বড় পরিসর ও অনেকটা স্বাভাবিক পরিবেশে এবার হজের আনুষ্ঠানিকতা পালন করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে বৃহস্পতিবার মিনায় তাবুতে অবস্থানের মধ্য দিয়ে পবিত্র হজের ধারাবাহিক পাঁচ দিনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন হাজীরা। এরপর আজ আরাফাতে অবস্থান, হজের খুতবা শোনা, মুজদালিফায় রাত যাপন, শনিবার মিনায় গিয়ে জামারায় পাথর নিক্ষেপ, কোরবানি আদায়, মাথা মুÐনের মধ্য দিয়ে এহরাম খুলে ফেলা এবং পরবর্তী দুই দিনে জামারায় পাথর নিক্ষেপ ও তাওয়াফে জিয়ারাহ সম্পন্ন করবেন হাজীরা।
আরব নিউজ জানিয়েছে, পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরবে হাজির হওয়া মুসলমানরা বুধবার পবিত্র নগরী মক্কায় কাবা শরীফ তাওয়াফ করেন। এরপর রাতে এশার নামাজের পর থেকে জড়ো হতে শুরু করেন কাবা শরিফের ১০ কিলোমিটার দূরে তাবুনগরী মিনায়।
৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তীব্র গরমের মধ্যে সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত বিভিন্ন বর্ণ, ভাষা, জাতীয়তার লাখো মুসলমান কেউ বাসে, কেউ গাড়িতে, কেউবা হেঁটে মিনার পথে রওনা হন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি।
সবার মুখে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়াননি'মাতা লাকা ওয়ালমুলক’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মিনা।
এর অর্থ হল, “আমি হাজির। হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই; সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার।”
অনেককেই গরম থেকে বাঁচতে মাথায় ছাতা ধরেন। বিধিনিষেধের কড়াকড়ি কমে আসায় হজযাত্রীদের অনেকে মাস্ক ছাড়াই হজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানিকতায় যোগ দিয়েছেন। তবে নিরাপত্তাসহ সার্বিক কার্যক্রমে নিয়োজিত সৌদি কর্মীদের মুখে মাস্ক দেখা গেছে।
সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হজে আসা ব্যক্তিদের জন্য মক্কা ও মিনায় ২৩টি হাসপাতাল এবং ১৪৭টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছে বলে জানিয়েছে আরব নিউজ।
এর মধ্যে শুধু মিনাতেই চারটি হাসপাতাল ও ২৬টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নিবিড় পরিচর্যার জন্য এক হাজার শয্যা এবং বিশেষ করে ‘হিট স্ট্রোকের’ রোগীদের জন্য দুইশর বেশি শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রোগীদের সেবায় নিয়োজিত থাকছেন ২৫ হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী।
মিশর থেকে হজ করতে এসেছেন ৬৫ বছর বয়সী আবদেল মোনেইম। আরব নিউজকে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই দেখছি। সব জায়গাতেই নিয়ম মানা হচ্ছে।
গরমে অতিষ্ঠ আরেক মিশরীয় নারী নাইমা মোহসেন (৪২) বলেন, হজ পালন আমার ভালো লাগে। আমার একমাত্র সমস্যা আবহাওয়া, প্রচÐ গরম।
করোনা পরিস্থিতির আগে ২০১৯ সালে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ পবিত্র হজে যোগ দেন। মহামারীর বিধিনিষেধের মধ্যে গত দুই বছর হজ হয়েছে খুব সীমিত পরিসরে। ২০২০ সালে কেবল সৌদি আরবে অবস্থানরত ১০ হাজার বিদেশিকে হজের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ২০২১ সালে তা বেড়ে হয় ৬০ হাজার।
সেই ভীতিকর পরিস্থিতি কেটে যাওয়ার পর কিছুটা বড় পরিসরে এ বছর বিশ্বের ১০ লাখ মুসলমানকে হজে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে সৌদি আরব। তাদের মধ্যে সাড়ে ৮ লাখ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন। বাকিরা সৌদি আরবের নাগরিক।
বাংলাদেশের মানুষও হজ করার সুযোগ পাচ্ছে দুই বছর পর। কোভিডের আগের বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে যেখানে সোয়া এক লাখের বেশি মানুষ হজে যাওয়ার সুযোগ পেতেন, এবার সে সুযোগ পেয়েছেন তার অর্ধেক।
করোনাভাইরাসের অন্তত দুই ডোজ টিকা নেওয়া থাকলে তবেই এবার হজে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে ঝুঁকি বিবেচনায় ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের সে সুযোগ হয়নি।
মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, আদি পিতা হজরত আদম ও আদি মাতা হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে পুনর্মিলনের পর এই আরাফাতের ময়দানে এসে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। ১৪০০ বছরের বেশি সময় আগে এখানেই ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (স.) দিয়েছিলেন তার বিদায় হজের ভাষণ।
এই আরাফাতে উপস্থিত না হলে হজের আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণাঙ্গ হয় না। তাই হজে এসে যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাদেরও অ্যাম্বুলেন্সে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হয় স্বল্প সময়ের জন্য।
ইসলামী রীতি অনুযায়ী, জিলহজ মাসের নবম দিনটি আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে ইবাদতে কাটানোই হল হজ।
এ বছর আরাফাতের ময়দানে হজের খুতবা দেবেন মসজিদে নামিরার খতিব মুহাম্মাদ আবদুল করীম আল-ঈসা। আরবিতে দেওয়া খুতবা তাৎক্ষনিকভাবে বাংলা সহ ১৪ টি ভাষায় অনুবাদ করে প্রচারিত হবে।
আরাফাত থেকে আবারও মিনায় ফেরার পথে শুক্রবার সন্ধ্যায় মুজদালিফায় মাগরিব ও এশার নামাজ পড়বেন সমবেত মুসলমানরা। মুজদালিফায় খোলা স্থানে রাতে থাকার সময় তারা পাথর সংগ্রহ করবেন, যা মিনার জামারায় শয়তানের উদ্দেশ্যে ছোঁড়া হবে।
শনিবার সকালে মিনায় ফিরে সেই পাথর তারা প্রতীকী শয়তানকে লক্ষ্য করে ছুঁড়বেন। এরপর কোরবানি দিয়ে ইহরাম ত্যাগ করবেন এবং সবশেষে কাবা শরিফে বিদায়ী তাওয়াফের মধ্যে দিয়ে শেষ হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা।
এদিকে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৩ জন সৌদি আরবে ইন্তেকাল করেছেন। সর্বশেষ গত ৪ জুলাই নওগাঁ জেলার মোঃ আব্দুল মোত্তালিব (৫৮) পবিত্র মক্কা আল-মুকাররমায় ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর পাসপোর্ট নম্বরঃ বিটি ০৬৮৬৭১০।